মতামত

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি উত্থানের নেপথ্যে

পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি উত্থানের নেপথ্যে

মোদি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরে বাংলাদেশের মুসলমান জনগণের বেদনা ধীরে ধীরে কমে এসেছে। ফেসবুকে আপাতত আর হাহাকার শোনা যাচ্ছে না। মোদির বিজয়ের পর ভারতের পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে কোনো ভারতীয় মুসলমান নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ৯৮ শতাংশ ‘সাচ্চা মুসলমানের দেশ’ পাকিস্তানে প্রবেশ করেনি। ঠিক তেমনি ভাবে পূর্ব সীমান্ত দিয়েও কোনো ভারতীয় মুসলমান বাংলাদেশে এসেছে বলেও খবর পাওয়া যায়নি।

ভারতের মুসলমানরা ৮০ শতাংশ হিন্দুর দেশ ভারতে থাকাটাকেই যুক্তিযুক্ত ও নিরাপদ মনে করেছে। অত্যন্ত প্রভাবশালী দেওবন্দ মাদ্রাসায় নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি যাতে ক্ষমতায় আসতে পারে-এই মর্মে যে দোয়া হয়েছিল, তা আর কবুল হয়নি। দেওবন্দের মাওলানারাও রোজা-ইফতারসহ বিভিন্ন ধর্মকর্ম নির্বিঘেœই পালন করছেন, মোদিকেও গালমন্দ করতে পারছেন, তাদেরকে কেউ গ্রেপ্তারও করেনি। ভারতে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক শক্তির জোর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের তুলনায় অত্যন্ত বেশি হওয়ায়, আপাতত সবাই স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন। মোদি সরকার সংখ্যালঘুদের কতখানি নিরাপত্তা দিতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।

এই নির্বাচনে বিজেপির অভাবনীয় সাফল্যের কারণে মোদিকে নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে-মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো কোনো নেতা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। রাজ্যে রাজ্যে উঠেছে বিজেপির গেরুয়া পতাকা। আমাদের পড়শি রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে যে বিজেপির কোনো অস্তিত্বই ছিল না, সেখানে বিজেপি ভালোমতোই থাবা বসিয়েছে। রকেট গতিতে উত্থান হয়েছে বিজেপির।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেখানে বিজেপির আসনসংখ্যা ছিল দুইটি, এবার তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮টি তে। কোনো আসন না পেয়ে বামফ্রন্ট কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। দুটি আসন নিয়ে টিমটিম করে জ্বলছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। দোর্দ- প্রতাপে পশ্চিমবঙ্গ শাসন করা আঞ্চলিক দল তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির উত্থানে কার্যত দিশেহারা। গত লোকসভায় প্রাপ্ত ৩৪টি আসন থেকে কমে তারা পেয়েছে ২২টি আসন। কয়েকটি কেন্দ্রে অল্প ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয় হয়েছে বিজেপি।

২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে হবে বিধানসভা নির্বাচন। আত্মবিশ্বাসে টগবগ বিজেপি ইতোমধ্যেই স্লোগান বানিয়ে ফেলেছে, ‘উনিশে হাফ, একুশে সাফ’। অর্থাৎ যে তৃণমূল ২০১৯ এর লোকসভা ভোটে অর্ধেক আসন পেয়েছে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তারা সাফ হয়ে যাবে, মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে ছিটকে পড়বেন তৃণমূলের সর্বেসবা মমতা বন্দোপাধ্যায়।

কেন পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপির এমন সাফল্য? যে পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যাসাগর, রামমোহন আর রবীন্দ্রনাথের মতো মহামনীষীর জন্ম দিয়েছে-সেখানে কট্টরপন্থার এত আস্ফালন কেন? কেমন আছেন পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা? তারা কি বিজেপির উত্থান নিয়ে শঙ্কিত? নাকি তারাও গোপনে গোপনে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে? নি¤েœর ছোট ছোট অনুচ্ছেদে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।

বিজেপির ‘আদি গুরুর’ জন্মস্থান পশ্চিমবঙ্গেই
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, হাইকোর্টের বিচারপতি এবং বাংলার বাঘ বলে পরিচিত-স্যার আশুতোষ মুখার্জীর ছেলে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দেশভাগের পূর্বেই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূচনা করেন এই পশ্চিমবঙ্গে। আজকের রাজনৈতিক দল বিজেপি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে তাদের অন্যতম আদর্শিক গুরু বলে মানে।

১৯৩২ সালে বৃটিশ সরকার যখন ‘কম্যুনাল অ্যাওয়ার্ড’ নামে নতুন পরিকল্পনা শুরু করে, তখন থেকেই শ্যামাপ্রসাদের হিন্দুত্ববাদী আন্দোলনের শুরু। সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ভিত্তিতে যখন আসন বন্টনের সিদ্ধান্ত হলো, তখন ৫৫ ভাগ মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত বৃহৎ বঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের আসন সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি হয়ে দাঁড়াল। ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়।

পশ্চিমবাংলার হিন্দু সম্প্রদায় ভাবল, অচিরেই তারা মুসলমানদের তুলনায় সবদিক থেকে পিছনে পড়বে। বাংলা ভাগ করার জন্য উচ্চকিত হয়ে উঠল এক শ্রেণির বর্ণহিন্দু নেতা। যে হিন্দু সম্প্রদায় লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলে বঙ্গভঙ্গ রদ করাল, তারাই চল্লিশের দশকে এসে বাংলাকে বিভক্ত করতে চাইল। হিন্দুর জন্য এক বাংলা, আর মুসলমানের জন্য আরেক বাংলা-এই ঘৃণ্য নীতির প্রবক্তাই হলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী।

শুধু তাই নয়, ১৯৪৭ সালের ২ মে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে চিঠি লিখে শ্যামাপ্রসাদ জানিয়ে দিয়েছিলেন, যদি ভারত অখ- থাকে, তাহলেও যেন বাংলাকে ভাগ করে দেওয়া হয়। সোহরাওয়ার্দী, শরৎ বোস আর কিরণ শঙ্কর রায়ের অখণ্ড বাংলা গড়ার উদ্যোগেরও তীব্র বিরোধিতা করেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। কট্টরপন্থী হিন্দু মহাসভায় আগেই যোগ দিয়েছিলেন তিনি। মূলত শ্রামাপ্রসাদের আন্দোলনের কারণেই বাংলা ভাগ অনিবার্য হয়ে উঠে। ইতিহাসবিদরা হিন্দুদের বাংলা ভাগ দেখে সকৌতুকে বলেন, কবরে শুয়ে নিশ্চয়ই হেসে উঠেছেন লর্ড কার্জন।

যা হোক, দেশ স্বাধীনের পর শ্যামাপ্রসাদকে মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানান নেহেরু। তিনি শিল্পমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তবে নেহেরুর সঙ্গে মতদ্বৈততার কারণে অচিরেই পদত্যাগ করেন। বাকি জীবন উগ্র হিন্দুদের সংগঠন আরএসএস এর প্রচারক হয়েই জীবন কাটান।

এর মাঝে আরেক হিন্দুত্ববাদী নেতা গোলওয়ালকারের সান্নিধ্যে এসে ‘জন সংঘ’ নামে রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেন। জন সংঘকে আজকের বিজেপির পূর্বসূরী হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। ১৯৫২ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনও পেয়েছিল এই দলটি। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় বিন্দুমাত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি এই দল। পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া ‘উদ্বাস্তুরা’ দলে দলে কমিউনিস্ট দলে যোগ দেয়। আর বাংলাকে শাসন করে কংগ্রেস ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত।

শ্যামাপ্রসাদ মারা যান ১৯৫৩ সালে। যে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বাংলার রাজনীতিতে কোনোদিন প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারেননি জীবিতকালে, ২০১৯ সালে এসে নরেন্দ্র মোদি তাঁকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেন। শ্যামাপ্রসাদের মতো উগ্র সাম্প্রদায়িক লোকই হয়ে উঠেছেন আধুনিক ভারতের উদাহরণ ।

দশকের পর দশক কংগ্রেস-বাম যুযুধান লড়াই
পঞ্চাশ-ষাট-সত্তরের দশকে কেন্দ্রের পাশাপাশি রাজ্যেও ক্ষমতায় ছিলো কংগ্রেস। দেশভাগের পর পশ্চিমবাংলার অবস্থা হলো করুণ। রাজ্যের আয়তন গেল কমে, আর জনসংখ্যা হলো দ্বিগুণ। পূর্ব বাংলা থেকে লাখ লাখ উদ্বাস্তু পশ্চিমবাংলায় ঠাঁই নেয়। বেকারত্ব, খাদ্যের অভাব, নাগরিক সুবিধাহীনতার কারণে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। জনগণের পুুঞ্জিভূত ক্ষোভকে আশ্রয় করে বাম দলগুলো সংগঠন বাড়ায়। কংগ্রেসের সমর্থন কমে যেতে থাকে। এর মধ্যে নকশালবিরোধী আন্দোলনে টালমাটাল হয়ে পড়ে পশ্চিমবঙ্গ। শক্ত হাতে নকশালদের দমন করেন কংগ্রেসের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়।

কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন ১৯৭৫ সালে। দেশব্যাপী তার জনপ্রিয়তার ধস নামে। এর প্রভাব পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। ১৯৭৭ সালে ক্ষমতায় আসে-কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্কসবাদী (সিপিএম)। পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠে ভারতের বাম রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। মুখ্যমন্ত্রী হন আমাদের বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের ছেলে জ্যোতি বসু।

কংগ্রেস আর বামদের মধ্যে এই রাজনীতির খেলার ত্রিসীমানার মধ্যেও বিজেপির অস্তিত্ব ছিল না। সবাই ধরে নিয়েছিল-প্রগতিশীল পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম নিয়ে কেউ কোনোদিন রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু কে জানত ২০১৯ এ এসে সব হিসাব পাল্টে যাবে?

মমতার শেষের শুরু: পঞ্চায়েত নির্বাচনে সীমাহীন গুণ্ডামো
কিন্তু কেন মমতার এত তাড়াতাড়ি জনপ্রিয়তার ধস নামল? ১০ বছর আগে যে বিজেপি বিধানসভায় একটা আসনও পায়নি, তারা কীভাবে এ রাজ্যের সর্বস্তরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে নিল? এ প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে মমতার অপরাজনীতির কৌশলের মধ্যে। মমতা তৃণমূল কংগ্রেস দলটি প্রতিষ্ঠাই করেছেন কংগ্রেস ভেঙে, কংগ্রেস থেকে নেতা বাগিয়ে এনে। ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট থেকেও দলে দলে লোক চলে আসলো মমতার দলে। মমতা এটাই চাইছিলেন। বামপন্থী দল সিপিএম ও কংগ্রেস থেকে লোক বাগিয়ে আনার উদ্দেশ্যেই হলো ওই দল দুটোকে ধ্বংস করে দেওয়া।

ওই দল দুটো কোমায় চলে গেলো কয়েক বছরের মধ্যেই। মমতার উদ্দেশ্য সফল। কিন্তু তার আরেকটা অসৎ উদ্দেশ্য ছিল। সেটা ছিলো, বিজেপিকে জায়গা দেওয়া। মমতা ভেবেছিলেন, কংগ্রেস আর সিপিএমকে যেহেতু প্রায় কবরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে, এবার বিজেপি রাজনীতি করুক। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন, পশ্চিমবাংলায় ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে সফল হওয়া যাবে না। আর মুসলমানরা তো বিজেপিকে ভোট দেবেই না। ফাঁকা মাঠে বছরের পর বছর গোল দিয়ে যাওয়ার মওকা বুঝি মিলল।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আর এক। ক্ষমতা পেয়ে মমতা অহংকারী হয়ে উঠেন। কাউকে পাত্তা দেন না। কেউ তাকে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করলেই তাকে ‘সিপিএমের চর’ বলে গাল দেন। ভিন্নমত একদম সহ্য করতে পারেন না। অবশ্য মমতা পশ্চিমবঙ্গে অনেক উন্নয়নমূলক আর মুসলমানদের জন্য বেশ কিছু জনহিতকর কাজ করেন। কন্যাশ্রী প্রকল্পের মাধ্যমে নারী শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে ভালো ভূমিকা রাখেন। পাহাড়ের সমস্যাও দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেন।

কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় সুশাসনের অভাব আর লেজুরভিত্তিক রাজনীতি। জনগণের মন বিষাক্ত হয়ে উঠে। যে সিপিএমের রাজনীতির করণে জনগণ মমতাকে ভোট দিল, দেখা গেল, মমতার মাঝেও সেই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

যা হোক, ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে দেশব্যাপী মোদি ঝড়েও মমতা পশ্চিমবঙ্গে ৩৪টি আসন ধরে রাখেন। মাত্র দুটি আসন পেয়ে পতনের প্রহর গুণে বামফ্রন্ট। অন্যদিকে দুটি আসন পেয়েও ১৭ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয় উজ্জীবিত বিজেপি। চারটি আসন পেয়েও শতাংশের হিসাবে চতুর্থ হয় কংগ্রেস।

মমতা বন্দোপাধ্যায়ের গুন্ডাতন্ত্র শুরু হয় রাজ্যের সর্বস্তরে। ২০১৬ সালেও বিধানসভা নির্বাচনে মমতা তার সাফল্য ধরে রাখেন। আবার ২১১ আসন পেয়ে সরকার গঠন করেন মমতা ব্যানার্জী। বিজেপি পায় মাত্র ছয়টি আসন। এর পরেই কুশাসনের আসল রূপটা দেখে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয় গোটা পশ্চিমবঙ্গে। এটি আমাদের দেশের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের মতো। তৃণমূলের মাস্তানি দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সমাজের সর্বস্তরের লোকজন। বিজেপিসহ অন্যান্য বিরোধীরা মনোনয়ন পর্যন্ত দাখিল করতে পারেনি। মানুষ চেয়ে চেয়ে দেখল বিনা প্রতিদ্বন্দি¦তায় তৃণমূলের লোকজন বিভিন্ন পঞ্চায়েতের দখল নিয়ে যাচ্ছে। ভোট দেওয়ার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হলো। আর বিজেপি কর্মীদের লাশ ঝুলছে গাছের ডালে, ধানক্ষেতে আর ডোবানালায়।

বিজেপির দাবি, তাদের ৫৪ জন নেতাকর্মী খুন হয়েছে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। এসব নেতার পরিবারবর্গকে মোদি তার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে কোনো রাজনৈতিক খুন খারাবি হয়নি, লাশ নিয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি-এই অযুহাতে মমতা শপথ অনুষ্ঠানে যাননি।

বিজেপির রকেট গতিতে উত্থান
নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর যদি হয় মমতার উত্থান পর্ব, তাহলে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে মাস্তানি হলো-মমতার শেষের শুরু। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয় বিজেপি। আর কোনো রাজ্যে এত সভা করেনি মোদি-অমিত শাহ জুটি।

পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতি কার্যত ধ্বংস হয়ে গেছে। কংগ্রেস টিমটিম করে জ্বলছে। মমতার অহংকার আর স্বৈরাচারী আচরণে বিরক্ত হিন্দু-মুসলিম সবাই। বিজেপির বাক্সে সবাই ভোট উপচে পড়েছে। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে, মুসলমানরা বিজেপিকে ভোট দেয়নি। যদিও চলনে বলনে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিজেপি কথা বলে রাজনৈতিক কারণে, মুসলমানরা বিজেপিকে একবার যাচাই করতেও চাইল। দেশজুড়ে মোদি হাওয়া তো আছেই। সব মিলিয়ে মমতার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে নি¤œগামী করেছে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন।

২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ ১৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশে পৌঁছে যায়। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একেবারেই প্রান্তিক শক্তি বিজেপি চরম শক্তিশালী হয়ে উঠে। মমতার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে হারার ভয়ে তৃণমূল কংগ্রেস ভারত বিখ্যাত নির্বাচনী কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোরকে ইতোমধ্যে নিয়োগ দিয়েছে। বিজেপিকে জায়গা দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ফাঁকা মাঠে গোল দেয়ার যে কৌশল মমতা নিয়েছিলেন,তা একেবারেই বুমেরাং হয়।

ঊনিশে হাফ, একুশে সাফ! সম্ভব?
এই স্লোগানের প্রবক্তা মমতার এককালীন ছায়াসঙ্গী তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের। মুকুল রায় একজন কংগ্রেসের কর্মী ছিলেন। কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই তিনি মমতার সঙ্গে ছিলেন। তৃণমূল কংগ্রেসের পুরো সাংগঠনিক কাঠামোটা তাঁরই দাঁড় করানো। জেলা কমিটি, ওয়ার্ড কমিটিসহ সব স্তরের নেতাদের সাথেই তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর তাঁর সাথে মমতার দুরত্ব তৈরি হয়। অহংকারী মমতা মুকুল রায়ের সঙ্গে বিরোধ মেটানোর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে বরং মুকুল রায়কে দল থেকে বহিষ্কার করেন।

২০১৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মুকুল রায় তৃণমূল থেকে পদত্যাগ করে বিজেপিতে যোগ দেন। মুকুল রায়কে পেয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপি। সংগঠনের কাজে সিদ্ধহস্ত মুকুল এবার সর্বশক্তি দিয়ে বিজেপি পুনর্গঠনের কাজে হাত দেন। আজকে বিজেপির উত্থানের পেছনে মুকুল রায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে বামফ্রন্টের ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলকে তুলনা করা যায়। ২০০৯ এ কম আসন পেয়ে বামফ্রন্ট যেমন আর রাজ্য রাজনীতিতে দাঁড়াতে পারেন, ঠিক তেমনি মমতা ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের পরাজয়ের পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। এমনটাই ভাবছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিক মহল।

তাইতো মুকুল রায় স্লোগান তুলেছেন-ঊনিশের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের যে অর্ধেক শক্তি ক্ষয় হলো, বাকি অর্ধেক ক্ষয় হবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে। মমতা বন্দোপাধ্যায় হারিয়ে যাবেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চ থেকে। হয়তো বিজেপির সাথে লড়াই হবে কংগ্রেস বা বামদের।

লক্ষ্যণীয় ব্যাপার- ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের পরে মমতার দল তৃণমূল থেকে দলে দলে লোকজন বিজেপিতে চলে যাচ্ছে। মমতা যেভাবে অন্য দল থেকে লোক বাগিয়ে এনেছিলেন, নিয়তির খেলায় মমতার দল থেকেও লোকজন এখন বিজেপিতে চলে যাচ্ছে। সময়ই বলে দিবে-মুকুল রায়ের স্লোগানের প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু।

লেখক:- আমিনুল ইসলাম, পরিচালক, ইংলিশ অ্যাডভেঞ্চার

 

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। West Bengal News 24-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আরও পড়ুন ::

Back to top button