গল্প

তুমি যাহা চাও

তুমি যাহা চাও

লেখক : শাহ্​নাজ মুন্নী

নিজেকে প্রাণপণে সংযত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম কি? আমার মনের মধ্যে একধরনের হীনম্মন্যতার সৃষ্টি হলো, ভাবলাম আমি বুঝি তার যোগ্য নই, আধুনিক নই, মনের সঙ্গে বিবেকের লড়াই শুরু হয়ে গেল, বিবেক বলছে, কাউকে জোর করে আটকে রেখে কিছুই পাওয়া যায় না, আর মন বলছে, আমিও তো ভালোবাসি, আমারও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার আছে। এই আত্মদ্বন্দ্বে আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলো। আমি বুঝলাম, আমাকে পালাতে হবে, সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আমাকে বসতে হবে নিজের মুখোমুখি। জানতে হবে কী চাই আমি, কে সত্য সেটা নয় বরং কোনটা সত্য, সেটাই জানতে হবে, তা যত কঠিন আর যত হৃদয় ভেঙে দেওয়ার মতো নির্মমই হোক না কেন!

বকুল প্রথমে কিছু বলতে না চাইলেও পরে আমার জেরার মুখে স্বীকার করেছে, স্পষ্ট করেই বলেছে, আমি বাড়িতে না থাকলে সে প্রায়ই গাজীপুরের ছায়া–বিথিতে পরাগের বাসায় যায়।

‘কী করো ওইখানে যেয়ে?’

রাগ, দুঃখ, ঈর্ষা আড়াল করে স্বাভাবিক কণ্ঠে জানতে চাইলে বকুল খানিকক্ষণ নীরব থেকে নিচু গলায় বলে,

‘কিছু না। বেশির ভাগ সময় চুপচাপ বসে থাকি। মাঝে মাঝে গল্প করি। পরাগ চাইলে নদীর পাশে, নয়তো শুধু অচেনা কোনো রাস্তা ধরে হাঁটি…’

‘কেন বকুল? কেন যাও ওর কাছে? কেন ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখো? আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়, বোঝো না তুমি? মনে হয়, তুমি বিশ্বাস ভেঙেছ, প্রতারণা করছ আমার সঙ্গে, আমি মানতে পারি না, কত দিন বলেছি তোমাকে, যেয়ো না…’

বকুল কথা বলে না। মাথা নিচু করে থাকে, হাতের আঙুলে ওড়না পেঁচায়। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরে পড়ে। বকুলের নিরাভরণ সৌন্দর্যে আবার মুগ্ধ হই আমি, মানুষের কান্নাও এত সুন্দর হয়? দুহাতে ওর কান্নাভেজা উষ্ণ সরল মুখটা তুলে ধরি, ঘরের ভেতর ঝরা বকুলের স্নিগ্ধ সুবাস ছড়িয়ে পড়ে, ব্যাকুল হয়ে বলি, ‘আমাকে ভালোবাসো না তুমি? পরাগকে ভালোবাসো? তাহলে ওকে বিয়ে করলে না কেন, বলো, কেন আমার সঙ্গে জড়ালে?’

‘পরাগ আমার বন্ধু। অন্য কিছু নয়, বলেছি তো তোমাকে, তা ছাড়া…’। বকুল কথা না শেষ করেই ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নিজেকে হঠাৎ খুব অসহায় আর অস্থির লাগে আমার।

‘ওফ! বকুল! আমি যদি একা একা কোনো মেয়ের বাসায় যাই, তার সঙ্গে হাঁটি, ঘুরে বেড়াই, আর বলি ও আমার বন্ধু, তোমার কেমন লাগবে বলো তো! পারবে সহজভাবে মেনে নিতে? তোমার কি নিজেকে প্রতারিত মনে হবে না?’

বকুলের ঠোঁট কাঁপে, হয়তো কিছু বলার জন্য, কিন্তু কিছুই বলে না সে, আমার প্রশ্নেরও কোনো উত্তর দেয় না। থাক এই মুহূর্তে উত্তর চাই না আমি। ওকে বরং সময় দিই, একা একা ভাবার সুযোগ দিই। ভাবুক, ওর জায়গায় আমাকে কল্পনা করে ভাবতে থাকুক। দেখি কী প্রতিক্রিয়া হয় ওর!

পাশের ঘরে এসে সিগারেট ধরাই, পায়চারি করি। আমি কি তবে নিজের অজান্তেই বকুলের আত্মাকে খাঁচায় বন্দী করেছি? দখল করেছি তাকে? নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছি? তাকে নিজের কেনা সম্পত্তি ভাবছি? বকুলকে দোষী করে নিজে জিততে চাইছি? আর বকুল? ওই বা কী চাইছে? পরাগের সঙ্গে এসব কি কেবল নির্দোষ ভাববিনিময়? নাকি ওর নিঃসঙ্গতা ঘোচানোর নিষ্পাপ চেষ্টা? আমি কি খুব নিষ্ঠুর আচরণ করেছি ওর সঙ্গে? বুঝতে পারি না। ইচ্ছা করে, জগতের সবাইকে শুনিয়ে চিৎকার করে কাঁদি। ইচ্ছা করে, জনে জনে ডেকে নিজের দুর্ভাগ্যের কথা বলি। জিজ্ঞেস করি, এমনটা কি আমার প্রাপ্য ছিল? গভীর এক হতাশা, ক্ষোভ আর সীমাহীন বেদনা আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এ রকম মনোভাবের সময়ই কি মানুষ তার সবচেয়ে প্রিয়জনকে নিজ হাতে হত্যা করার মতো ভয়ানক সিদ্ধান্ত নেয়? আমিও কি নিজের শিক্ষা-সংস্কৃতি-নীতি-নৈতিকতা বোধ সব ভুলে গিয়ে তেমন ভয়ংকর কিছু করে ফেলব? মনের এই প্রচণ্ড অশান্তি, এই গোপন তাণ্ডব সামাল দিতে গিয়ে বুকের ভেতর একটা অজানা চাপ অনুভব করলাম আমি, তলিয়ে গেলাম শূন্যতার অতল গহ্বরে, তারপর সেখান থেকে সমস্ত শক্তি দিয়ে আবার নিজেকে টেনে তুললাম। আর বুকে পাথর বেঁধে সিদ্ধান্ত নিলাম, আমার যা হয় হোক, হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাক, জীবন এলোমেলো হয়ে পড়ে থাকুক, কিন্তু বকুল যা চাইবে, তাই হবে, আমি যত দুঃখই পাই না কেন। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব সহজ ছিল না, কিন্তু এ ছাড়া আর কীই-বা করার ছিল আমার!

তিন কামরার ছোট্ট বাসার গুমোট নিস্তব্ধতা ভাঙতে গলা উঁচু করে বকুলকে শুনিয়ে বললাম, ‘এক কাপ চা হবে নাকি?’

বকুল এলাচি-দারুচিনি দিয়ে আমার পছন্দের মাসালা চা নিয়ে এলে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলি, ‘পরাগকে একদিন বাসায় ডাকো, চা খেতে খেতে আলাপ করি।’

(আমার প্রতিপক্ষের ধূর্ত চেহারাটা দেখি, তার ব্যক্তিত্ব মাপি, শক্তি আর দুর্বলতা যাচাই করি। দেখি কী জাদু আছে ওর মধ্যে, যা আমার মধ্যে নেই। নিজেকে ওর পাশে দাঁড় করিয়ে দেখি আমরা ঘাটতিটা কোথায়?)

বকুল চমকে উঠে ভীরু হরিণীর মতো চকিত চোখে আমার দিকে তাকায়। ‘কেন?’

‘বাহ্ তোমার বন্ধু তো আমারও বন্ধু, সেই বন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হব না? অসুবিধা আছে?’

বকুল অস্ফুট কণ্ঠে বলে, ‘পরাগ কখনোই এখানে আসতে পারবে না।’

ক্রুদ্ধ উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠি আমি, ‘কেন আসতে পারবে না? আসার সাহস নেই বলে, তাই না? ভীরু, কাপুরুষ একটা! আমার মুখোমুখি হতে ভয় পায়? সম্পর্কের দায়িত্ব নিতে ভয় পায়? ডাকো ওকে, বলো তোমাকে নিয়ে যেতে, আমার কোনো আপত্তি নেই। তুমি মুক্ত, যখন ইচ্ছা ওর সঙ্গে চলে যেতে পারো! আমার আর কিচ্ছু বলার নেই।’

একতরফা রায় ঘোষণা করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি, হাতে ধরা চা–ভর্তি কাপটা একঝটকায় মেঝেতে ছুড়ে ফেললাম। ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গেল কাপটা, চা ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। যেন চায়ের কাপ নয়, আমার সমস্ত অস্তিত্ব, আমার বিশ্বাস, ভরসা আর এত দিনের ভালোবাসা একমুহূর্তে ভেঙে পড়ল। বকুল নিচু হয়ে বসে কাপের ভাঙা টুকরোগুলো একসঙ্গে জড়ো করল। ঘর মোছার কাপড় এনে মেঝেতে পড়ে থাকা চা মুছল। তারপর ভাঙা কাপের টুকরোগুলো একটার সঙ্গে আরেকটাকে লাগিয়ে নিয়ে বিষণ্ন গলায় নিজের মনেই বলল, ‘কী সুন্দর ছিল কাপটা, আর কি জোড়া লাগবে?’

আমি ততক্ষণে ঝড় থেমে যাওয়ার পরের আকাশের মতো শান্ত আর নিশ্চুপ। মাথায় এলোপাতাড়ি কত রকমের চিন্তা আসছে, মনে হচ্ছে যেন একটা প্রচণ্ড ঘূর্ণির তাণ্ডবে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। নিজেকে মনে হচ্ছে একটা ধু ধু বালুচর, তৃণহীন, বৃক্ষহীন বিরান ভূমি। বকুল আর আমার মাত্র ছয় মাসের সংসার, এখনো একজন আরেকজনকে ভালোভাবে চিনেই উঠতে পারিনি, আর এরই মধ্যে মিছে হয়ে গেল সব। সব খেলা সাঙ্গ হলো! এ কেমন খেলা? এ কেমন লীলা? বুঝি না। নিজেকে সান্ত্বনা দিই, যা হয়েছে তা ভালোই হয়েছে, যা হচ্ছে তা ভালোই হচ্ছে, যা হবে তা-ও ভালোই হবে। তারপরও বোকার মতো আমি কেন কাঁদছি? কেন নিজেকে এমন সব হারানো মানুষের মতো শূন্য, দীনহীন মনে হচ্ছে? আমি ঠিক করেছি, নিজে গিয়ে সব দাবি ছেড়ে বকুলকে পরাগের বাড়িতে দিয়ে আসব, বকুলের ভালোর জন্য যা যা করা দরকার, তার সব করব।

‘না। ধন্যবাদ। আমার কিসে ভালো, কিসে মন্দ, সেটা না হয় আমাকেই বুঝতে দাও।’

আমি গাড়ি দিয়ে তাকে পৌঁছে দিতে চাইলে শান্ত গলায় বলল বকুল।

আমাকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে গেল একাই, যেন ডানা ঝাপটে চোখের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল একটা সাদা পাখি। নিজেকে মনে হলো স্বনির্মিত কারাগারে বন্দী হয়ে থাকা এক বিধ্বস্ত কয়েদি। কতক্ষণ ছটফট করলাম। বোতল খুলে ব্যাপক মদ্যপান করলাম সিনেমার বিরহী নায়কের মতো, মড়ার মতো পড়ে রইলাম। প্রিয় গানগুলো শোনার চেষ্টা করলাম। নিজের ভেতরের যন্ত্রণার আগুন নিভল না কিছুতেই, বরং দ্বিগুণ পোড়াতে শুরু করল, শুতে পারলাম না সুস্থির হয়ে, ঘুমাতে পারলাম না একটুও, কিছুতেই সামান্যতম শান্তি না পেয়ে শেষ পর্যন্ত ভোরবেলা গাড়ি নিয়ে বের হলাম, উদ্দেশ্যহীন চালাচ্ছি, অনির্দিষ্ট ঠিকানায়, চালাতে চালাতে দেখি আমি কখন যেন উঠে পড়েছি গাজীপুরের রাস্তায়। হ্যাঁ, ছায়া-বিথিতেই যাচ্ছি আমি, যেখানে বকুল যেত সেই পরাগের বাড়িতে।

ছোট্ট জায়গা, একে ওকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চয়ই বাড়িটা খুঁজে পাব। সরু গলি, ছোট ছোট দোতলা, তিনতলা বাড়ি, টিনের সেমিপাকা ঘর, ঝাঁকড়া আমগাছ, টং দোকান, নির্জন মাঠ, ডোবা পেরিয়ে গেলাম। সূর্য চনচন করে আলো ছড়ালে রাস্তার পাশে একটা বাঁশের ঝাঁপ দেওয়া চা দোকানের সামনে গাড়ি থামাই, কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চে বসে গরুর দুধ দিয়ে বানানো মালাই চা খাই। একটা তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চা এসেছে গোল টুপি মাথায় দিয়ে, বাবার সঙ্গে, চুকচুক করে চুমুক দিয়ে দুধ–চা খাচ্ছে। বাবা খুশি খুশি গলায় গল্প করছে পাশের জনের সঙ্গে, ‘এই চা না খাইলে তার চলেই না। ছয় মাস ধইরা পরতেক দিন সকালবেলা অরে এই চায়ের দোকানে নিয়া আসতে হয়।’

আমি চা-পিয়াসী ছোট্ট ছেলেটাকে দেখি, গোলগাল চেহারা, কোমল ত্বক, লাজুক মুখ আর জ্বলজ্বলে দুটি চোখ। আমার তখন মনে পড়ে, এই এলাকায় আমি পরাগের বাড়ি খুঁজতে এসেছি। চায়ের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করি, চা–পানরত, দোকানে আড্ডারত, পথে হেঁটে যাওয়া মানুষজনের কাছে জানতে চাই কেউ পরাগকে চেনেন কি না, পরাগের বাড়ি চেনেন কি না? লোকজন মাথা নাড়ে, বয়স্করা পাল্টা জিজ্ঞেস করে, ‘উত্তর ছায়া-বিথি, না দক্ষিণ ছায়া-বিথি? পূর্বপাড়া না পশ্চিমপাড়া? উনার বাপের নাম কী বলেন? কত দিন ধরে এই এলাকায় থাকে? ছাত্র না কর্মজীবী? চাকরি করে না ব্যবসা? নিজের বাড়ি না ভাড়াটিয়া?’

মানুষের এত প্রশ্ন কেন? কেন তারা তাকায় আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে? কেন তারা হাসে, বলে ভালো করে ঠিকানা জেনে নিয়ে আসেন। আমার তখন প্রচণ্ড রোখ চেপে যায়, পরাগের বাড়ি খুঁজে বের করতেই হবে। আমি প্রতিটি বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ি, এটা কি পরাগের বাড়ি? আপনারা কি চেনেন পরাগকে? ছায়া-বিথিতে নয় যেন আমি চক্রাকারে ঘুরছি কোনো অচিন গহ্বরে। ঘুমাতে ঘুমাতে হাঁটছি, ঢুলছি, হাঁটতে হাঁটতে ঘুমাচ্ছি। এই পৃথিবীতে কোথাও কি সে নেই? এই পথে, এই ঘাসে, এই সব কোলাহলে ভরা ছায়া-বিথির বাড়িগুলোতে কেউ কি চেনে না পরাগকে?

‘পরাগ? কোন পরাগের কথা বলছ তুমি, বাবা?’

একটা আধভাঙা প্রাচীরঘেরা পুরোনো বাড়ির শ্যাওলা পড়া উঠানে দাঁড়িয়ে সাদা চুলের এক থুত্থুড়ে বুড়ি জিজ্ঞেস করে আমাকে, ততক্ষণে সন্ধ্যার অন্ধকার ঝুঁকে এসেছে লম্বা নিমগাছের মাথায়। আমি তার কাছাকাছি এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলি, ‘বকুলের বন্ধু পরাগের কথা বলছি আমি, তার বাড়িটা খুঁজছি, বুড়িমা।’

বুড়ি লাঠিতে ঠুকঠুক শব্দ তুলে কাঠের ভারী দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর আবার ফিরে আসে, হাতে একটা সাদা–কালো ফটোগ্রাফ। ঝাপসা হয়ে গেছে ছবিটা। অস্পষ্ট বোঝা যায় এক তরুণের ফ্যাকাশে রুগ্​ণ মুখ, মাথায় লতিয়ে থাকা কালো চুল আর তার দুটি করুণ সুন্দর চোখ।

‘এই তো পরাগ।’ বুড়ি বলে, ‘এই পথ ধরে যাও, শিমুলগাছের তলে গভীর অন্ধকারে পরাগের বাড়ি, ওইখানে এক বছর ধরে, একা একা শুয়ে আছে সে। বকুলের বন্ধু পরাগ।’

Back to top button