সাহিত্য

নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন
কাজী নজরুল ইসলাম

মৃত্যুঞ্জয় সরদার, কলকাতা: পুঁথিগত শিক্ষা বা ডিগ্রিধারী মানুষরা সমাজের শাসন ব্যবস্থায় উচ্চতর স্থানে বিরাজমান ।শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড, শিক্ষায় শিক্ষিত হলেই মানুষ প্রকৃত মানুষ হয় না। আদর্শগত শিক্ষার দাম অনেক বেশি, আজকের সমাজের সেই মূল্য পায় না।আজও অনেক মানুষ আছে অল্প শিক্ষিত বা নিজের চেষ্টায় কোনরকম উচ্চশিক্ষা স্থানে স্থান পেয়েছে কিন্তু সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।তাদের লেখনি, গুণগতমান, আদর্শ এবং সত্যবাদী দের  মূল্য তো আমরা দিতে পারি না।আজকের সমাজ ব্যবস্থায় এতটা জঘন্য, প্রকৃত মানুষকে আমরা হে পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে বলে, আজকের সমাজের আরো জঘন্যতম জায়গায় চলে এসেছে।

নিজেদের স্বার্থের জন্য আজ মানুষকে কত রকম ভাবে বিভেদ করে রেখেছি। হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান জৈন, বৌদ্ধ , ধর্মভিত্তিক ভাগ্যের পিছনে সমাজের মাথাদের  একটা সার্থ লুকিয়ে রয়েছে। এ বিষয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিল নজরুল ।তাই তার সৃষ্টিকর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন। কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দোরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন। নজরুলের ইতিহাস-চেতনায় ছিল সমকালীন এবং দূর ও নিকট অতীতের ইতিহাস, সমভাবে স্বদেশ ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব।বাংলা তথা ভারতবর্ষের মানুষ কাজী নজরুল ইসলামের সমভাবাপন্ন নীতি আদর্শ  কথা ভিত্তিক চললে ভারতবর্ষে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা টাই অন্তত বন্ধ থাকতো।

এই সময় দাঁড়িয়ে নজরুল ইসলামকে নিয়ে কতগুলো জীবনী লেখা হয়েছে, তার সংখ্যা আমার জানা নেই। তবে আমার বিশ্বাস, অত জীবনী অন্য কোনো বাঙালিকে নিয়ে লেখা হয়নি, এমনকি রবীন্দ্রনাথকে নিয়েও নয়। এর একটা কারণ নজরুল সম্পর্কে সঠিক তথ্যের অভাব। বিশেষ করে সৈন্যবাহিনী থেকে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার আগের সময়টা আমাদের কাছে একান্ত অস্পষ্ট। শোনা কথা, যে যা কল্পনা করতে পেরেছেন, তিনি তাই লিখেছেন।

তাঁর সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিতে পারতেন, এমন কোনো যোগ্য আত্মীয় তাঁর ছিল না। তাঁর দুই ভাই ছিলেন, লেখাপড়া সামান্যই জানতেন। তাঁরা তাঁর জীবন সম্পর্কে নতুন কোনো আলোকপাত করতে পারেননি। তাঁরা দেখেছিলেন বালক এবং কিশোর নজরুলকে, যাঁর বালকসুলভ কাজকর্ম তাঁদের মনে থাকার কথা নয়।  বর্তমানে বাংলা-পড়ুয়াদের পিএইচডি করার যুগ। সেই সূত্রে অনেকেই জীবনীর কিছু তথ্য এবং সাহিত্যের কিছু আলোচনা দিয়ে ‘অমুকের জীবন ও সাহিত্য’ নামে অসংখ্য কাজ করেন। এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ মুদ্রিত হয়ে বই আকারে প্রকাশিতও হয়।

মুশকিল হলো, এসব কাজ না সত্যিকার জীবনী, না সত্যিকার সাহিত্য-বিচার। এগুলোকে বলা যায়, জীবনের তথ্য ও সন-তারিখের ফর্দ এবং বিবরণ। সেই সঙ্গে সাহিত্যের খবর। কোন বই কবে প্রকাশিত হয়েছিল, বিষয়বস্তু কী, এবং এখান সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি। এক কোথায় গবেষণা। এই গবেষণা কে সাহিত্য-আলোচনা একে ঠিক বলা যায় না। কারণ, এতে সাহিত্যের বিশ্লেষণ, রসাস্বাদন অথবা মূল্যায়ন তেমন থাকে না। সবচেয়ে কম মেধা নিয়ে এই ধরনের জীবন ও সাহিত্য মার্কা-মারা গ্রন্থ রচনা করা যায়।

বলা যায় যে, এগুলো জীবনী নয়, এগুলো হলো ব্যক্তি বিশেষের পরিচিতিমূলক গ্রন্থ বা গবেষণাপত্র।ছোটবেলা থেকে একটি নেশা ছিল অল্প শিক্ষিত মানুষকে নিয়ে গবেষণা করা, এবং তার তথ্য পরিবেশন করা।অল্প শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে বসে লেখাপড়া শিখে ছিলেন।অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম অষ্টম শ্রেণী পাশ থেকে সেনাবাহিনী, সেনাবাহিনী থেকে এখন তিনি একজন খ্যাতিমান কবি।আমার লেখার বিষয়বস্তু অল্পশিক্ষিত কবি নজরুলের জীবনের ইতি কথা।

বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশ শাসিত ভারতে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন । তাঁর বাবার নাম ফকির আহমেদ ও মায়ের নাম জাহেদা খাতুন । তিনি ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ ও দার্শনিক । বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, দেশপ্রেমী এবং বাংলাদেশের জাতীয় কবি । চুরুলিয়া অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার আসানসোলের নিকট অবস্থিত । কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া” । পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ  – দুই বাংলাতেই তার কবিতা ও গান সমানভাবে সমাদৃত ।

বিংশ শতাব্দীর বাংলা মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম । এযুগে কাজী নজরুলের মতন অর্থহীন পরিবারের লেখকও আজও আছে। কিন্তু সেই সব লেখকদের আমরা মর্যাদা দেই না, বা স্বীকৃতি দিতে রাজি না। বর্তমান যুগে নজরুলের মতো অসংখ্য আদর্শবান কবি লেখক ও সৎ নিষ্ঠা ব্যক্তিত্বের রাজ্য আছে এই সভ্যতার মধ্যে লুকিয়ে। আমরা তাদেরকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে এক অজানা শক্তি, অকারণে, অবিচারে। এ কারণেই নজরুল কথাগুলো আজকের সমাজের কাছে ভীষণ ভাবে প্রাধান্য পাবে।এই সমাজের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যেতে পারি।

পুঁথিগত শিক্ষায় শুধু শিক্ষিত হলে যে প্রকৃত মানুষ হওয়া যায় এটা ঠিক নয়। সেই জন্য কি নজরুল তাঁর কবিতায় ব্যতিক্রমী এমন সব বিষয় ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা আগে কখনও ব্যবহূত হয়নি। কবিতায় তিনি সমকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক যন্ত্রণাকে ধারণ করায় অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তবে মানবসভ্যতার কয়েকটি মৌলিক সমস্যাও ছিল তাঁর কবিতার উপজীব্য।এছাড়াও নজরুল তাঁর সৃষ্টিকর্মে হিন্দু-মুসলিম মিশ্র ঐতিহ্যের পরিচর্যা করেন। কবিতা ও গানে তিনি এ মিশ্র ঐতিহ্যচেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দোরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেন।

বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন এবং লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা গানকে উপমহাদেশের বৃহত্তর মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি নজরুলের মৌলিক সঙ্গীতপ্রতিভার পরিচায়ক। নজরুল সংগীত  বাংলা সঙ্গীতের অণুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। যাক এসব কথা এই কথাগুলো লেখার আগে নজরুল সম্পর্কে আমাদের জানার খুব প্রয়োজন।

তাই নজরুলের ব্যক্তিগত জীবন থেকে কবি হওয়া ওঠার সফলতা তুলে ধরছি আমার কলমে। নজরুলের যখন দশ বছর বয়স তখন তিনি গ্রামের মক্তব থেকে নিম্ন প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । তাঁর পিতার মৃত্যু হলে তাকে বাধ্য হয়ে উপার্জনের চেষ্টা করতে হয় । গ্রামের মৌলবিদের সাহায্যে মক্তবে ছোটদের পড়া মুখস্থ করানোর জন্য এক পীরের দরগায় কাজের ব্যবস্থা হয় । এখানে দুই বছর তাঁর অতিবাহিত হয় । শৈশব থেকে তিনি লোকনাট্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন । এরপর তিনি ভ্রাম্যমাণ ‘লেটো’ গানের দলে যোগ দেন ।

সেই দলের জন্য তিনি গান গাইতেন, গান ও পালা রচনা করতেন । তিনি পালা গান রচনা করতে গিয়ে হিন্দু দেব-দেবী সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন । এখানে শুধু শেষ নয়!তিনি বাসুদেবের শখের কবি গানে যোগ দেন । এখানে তিনি গান লিখেছেন, সুর দিয়েছেন ও নিজে গান গেয়েছেন । সেখান থেকে তাঁকে এক বাঙালি খ্রিস্টান গার্ড বাবুর্চি কাজের জন্য নিয়ে যান । সেখানে ভাল না লাগার জন্য তিনি আসানসোলে এক চা রুটির দোকানে কাজ করতে লাগলেন । দোকানে থাকার যায়না না থাকার জন্য তিনি পাশে এক তেতলা বাড়ির সিঁড়ির নীচে থাকতেন ।

সেই বাড়িটি ছিল এক পুলিশ ইন্সপেক্টর কাজী রফিউল্লাহ ও তাঁর স্ত্রী শ্যামসুন্নেসার । তাঁরা নজরুলকে ময়মনসিংহ এর দরিরাম পুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন । এরপর তিনি রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন ।এই প্রসঙ্গ তে বলে রাখি, মুসলমান-প্রধান বাংলাদেশে নিরাসক্ত নজরুল-জীবনী রচনা করার একটা মস্ত বাধা হলো, তাঁর সত্যিকার ধর্মীয় পরিচয়। তিনি মুসলিম পরিবারে জন্মেছিলেন, জীবনের একটা পর্যায় পর্যন্ত তিনি ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে নিজেকে শনাক্ত করতেন।

তারপর তিনি যে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে কেবল মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন, এ কথা বললে রক্ষণশীলদের অনেকেই তেড়ে আসবেন। জীবনের একটা পর্যায়ে তিনি যে কালীর সাধনা করতেন, সে কথা শুনলে এই রক্ষণশীলেরা লাঠি মারবেন কি না, জানা নেই।আসলে বাংলাদেশে ও বাংলায় নজরুল ইসলাম সম্পর্কে নির্মোহ বিচার করা শক্ত। একদল লোক আছেন, যাঁরা তাঁর সম্পর্কে সত্য কথা শুনতে চান না,বাংলা তথা ভারত বর্ষ বাংলাদেশি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে।

অক কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে রাজনীতি চলছে বর্তমান সময়ে। তবে একজন বড় কবির সবকিছুই বড় মাপের হবে, সর্বাঙ্গীণ সুন্দর এবং সুগোল হবে—এমন কি কোনো কথা আছে? মাইকেল মদ্যপ ছিলেন, তাই বলে কি মহাকবি হিসেবে তাঁর মূল্য কিছু কমে গেছে? বোদলেয়ারের মৃত্যু হয়েছিল সিফিলিসে ভুগে, তাঁর জন্য কি কবিতা মূল্য হারিয়েছে? হারায়নি। বরং দেড় শ বছর পরেও রোমান্টিক কবি হিসেবে তিনি ভাস্বর। তেমনি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিত্রকর রাফায়েল মারা গিয়েছিলেন সিফিলেসে ভুগে, তার জন্য তাঁর চিত্রের মূল্য কি কিছুমাত্র হ্রাস পেয়েছে? নজরুল-জীবনেও অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল, অন্ধকার দিক ছিল।

কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্য এবং সংগীত-আকাশের চোখধাঁধানো জ্যোতিষ্ক। তাঁর জীবনের একসময়ে তিনি ‘খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’ বিস্ময়ের মতো আবির্ভাবের ঘোষণা দিয়েছিলেন; ভগবান-বুকে পদচিহ্ন এঁকে দিতে চেয়েছিলেন—সমকালীয় রক্ষণশীল লোকেরা অনেকে এ কথাগুলোকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করে তাঁকে নমরুদ, ফেরাউন ও কাফের আখ্যা দিয়েছিলেন। যাক এসব কথা ফিরে আসি নজরুল জীবনের কাহিনী নীতিকথা তে।

মকতব, মাযার ও মসজিদ-জীবনের পর নজরুল  রাঢ়  বাংলার (পশ্চিম বাংলার বর্ধমান-বীরভূম অঞ্চল) কবিতা, গান আর নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক লোকনাট্য  লেটোদলে যোগদান করেন। ঐসব লোকনাট্যের দলে বালক নজরুল ছিলেন একাধারে পালা গান   রচয়িতা ও অভিনেতা। নজরুলের কবি ও শিল্পী জীবনের শুরু এ লেটোদল থেকেই। হিন্দু পুরাণের সঙ্গে নজরুলের পরিচয়ও লেটোদল থেকেই শুরু হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে কবিতা ও গান রচনার কৌশল নজরুল লেটো   বা কবিগানের দলেই রপ্ত করেন।

এ সময় লেটোদলের জন্য কিশোর কবি নজরুলের সৃষ্টি চাষার সঙ, শকুনিবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের সঙ, বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ, মেঘনাদ বধ প্রভৃতি।এদিকে ১৯১০ সালে নজরুল পুনরায় ছাত্রজীবনে ফিরে যান। প্রথমে তিনি রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুল এবং পরে মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে (পরে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন) ভর্তি হন। শেষোক্ত স্কুলের হেড-মাস্টার ছিলেন কবি রঞ্জন মল্লিক  ; নজরুল তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেন।

দুর্ভাগ্যক্রমে আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণির পর নজরুলের ছাত্রজীবনে আবার বিঘ্ন ঘটে। মাথরুন স্কুল ছেড়ে তিনি প্রথমে বাসুদেবের কবিদলে, পরে এক খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা পদে এবং শেষে আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নেন। এভাবে কিশোর শ্রমিক নজরুল তাঁর বাল্যজীবনেই রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে সম্যকভাবে পরিচিত হন। চা-রুটির দোকানে চাকরি করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয় এবং তাঁর সুবাদেই নজরুল ১৯১৪ সালে ময়মনসিংহ   জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন।

এক বছর পর তিনি পুনরায় নিজের গ্রামে ফিরে যান এবং ১৯১৫ সালে আবার রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এ স্কুলে নজরুল ১৯১৫-১৭ সালে একটানা অষ্টম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষার সময় ১৯১৭ সালের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ছাত্রজীবনের শেষ বছরগুলিতে নজরুল সিয়ারসোল স্কুলের চারজন শিক্ষক দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হন। তাঁরা হলেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী ভাবধারায় নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফারসি সাহিত্যে হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্যচর্চায় নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এখানে নজরুলের জীবন থেমে থাকে নি।১৯১৭ সালের শেষদিক থেকে ১৯২০ সালের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর নজরুলের সামরিক জীবনের পরিধি। এ সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্টের একজন সাধারণ সৈনিক থেকে ব্যাটেলিয়ন কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবির নিকট তিনি ফারসি ভাষা শেখেন, সঙ্গীতানুরাগী সহসৈনিকদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র   সহযোগে সঙ্গীতচর্চা করেন এবং একই সঙ্গে সমভাবে গদ্যে-পদ্যে সাহিত্যচর্চা করেন।

করাচি সেনানিবাসে বসে রচিত এবং কলকাতার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত নজরুলের রচনাবলির মধ্যে রয়েছে ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’ ( সওগাত, মে ১৯১৯) নামক প্রথম গদ্য রচনা, প্রথম প্রকাশিত কবিতা ‘মুক্তি’ (বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা , জুলাই ১৯১৯) এবং অন্যান্য রচনা: গল্প ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহের নেগার’, ‘ঘুমের ঘোরে’; কবিতা ‘আশায়’, ‘কবিতা সমাধি’ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য যে, করাচি সেনানিবাসে থেকেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্যপত্রিকা, যেমন:  প্রবাসী ,  ভারত বর্ষ  , ভারতী  , মানসী  , মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র , সওগাত   গ্রাহক ছিলেন।

তাছাড়া তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি ফারসি কবি হাফিজেরও কিছু গ্রন্থ ছিল। প্রকৃতপক্ষে নজরুলের আনুষ্ঠানিক সাহিত্যচর্চার শুরু করাচির সেনানিবাসে থাকাবস্থায়ই। ১৯২১ সালে কুমিল্লায় গিয়ে নার্গিস আসার খানমের সাথে তাঁর বিবাহ হয় । কিন্তু, বিবাহে ঝামেলা হওয়ার জন্য তিনি তাঁর পরিচিত সেনগুপ্তের বাড়ি চলে আসেন । পরে প্রমীলা দেবী ও নজরুল তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন । গোঁড়ামি, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর । শুধু তাই নয়! কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন ।

নজরুল রবীন্দ্রনাথ, পারস্য কবি হাফেজ ও খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন । এখান থেকেই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয় । এই সময় ভারতীয়রা ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়িয়েছিল । তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ব্রিটিশদের নিষ্ঠুরতার প্রতিবাদ করেছিলেন । প্রতিবাদের ভাষা হিসাবে তিনি গান, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি লিখতে শুরু করেন । নজরুল এ সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন এবং স্বরচিত স্বদেশী গান পরিবেশন করে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতেন ।  ১৩২৬ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় মুসলমান নামক সাহিত্য পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবিতা ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয় ।

এসময় তিনি ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন । তিনি কুমিল্লা, মেদিনীপুর, হুগলি, ফরিদপুর, বাঁকুড়া এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ করেন ।  তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে ভারতীয় যুবকদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে প্রেরণা যোগাতেন । ব্রিটিশ শাসকরা ভয় পেলেন যে – নজরুলের লেখা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্ররোচিত করবে ।এদিকে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি হয় । বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন ।

তাঁর কবিতা শুধু ইংরেজ শাসকের বিরুদ্ধে প্রতীবাদ নয়, সমাজের সমস্ত রকম অসাম্য, অন্যায়, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে । তাঁর কবিতার আর একটি বিশেষত্ব হল হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের ঐতিহ্যের সার্থক মেলবন্ধন ।১৯২২ সালে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা প্রকাশ করেন । ব্রিটিশরা ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় তল্লাশি চালায়, কবিকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় । এরপর তাঁকে হুগলী জেলে স্থানান্তরিত করা হয় । তিনি এখানে অনশন শুরু করেন । এক মাসের বেশি তিনি অনশন করেন । ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে নজরুলকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় । ১৯২৫ সালে তিনি সাপ্তাহিক ‘লাঙ্গল’ পত্রিকা প্রকাশ করেন ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর এত কবিতা, গল্প, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ আর গান কেউ লেখেন নি । ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত । নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি । তাঁর রচিত ও সুরারোপিত গান গুলিকে নজরুল সঙ্গীত বলা হয় । তাঁর রচিত বইগুলি হল – অগ্নিবীণা, বিষের বাঁশি, সাম্যবাদী, সর্বহারা, ফণীমনসা, প্রলয় শিখা ইত্যাদি । নাটক – দাতা কর্ণ, কবি কালিদাস, রক্তকমল, মহুয়া, জাহাঙ্গীর, কারাগার, সাবিত্রী, আলেয়া, সর্বহারা, সতী । ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক নজরুলকে প্রদান করা হয় ।

১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে  ভূষিত করা হয় । ১৯৪০ সালে কবি স্ত্রী প্রমীলা কঠিন পক্ষাঘাত হয় । কবি মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়েন, তাঁর মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে । ১৯৪২ সালে তিনি একেবারে মূক হয়ে যান । দেশে বিভিন্ন ভাবে তাঁদের চিকিৎসা করা হয় । এখানে চিকিৎসায় সফল না হওয়ার জন্য বিদেশে লন্ডনে, ভিয়েনায় পাঠানো হয় ।  কবির স্ত্রীর মৃত্যু হয় ১৯৬২ সালে । ১৯৭১ সালে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ তৈরি হয় । ১৯৭২ সালে নজরুলকে বাংলাদেশের ঢাকাতে নিয়ে যাওয়া হয় ।

১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা হয় । ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।  কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় ।  বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় ।

 

আরও পড়ুন ::

Back to top button