ঝাড়গ্রাম

মন্দির কমিটির দুই মাথা বিজেপিতে, থমথমে চিল্কিগড়

স্বপ্নীল মজুমদার

মন্দির কমিটির দুই মাথা বিজেপিতে, থমথমে চিল্কিগড়
প্রতিবেদকের তোলা ছবি

স্বপ্নীল মজুমদার, ঝাড়গ্রাম: ঐতিহ্যের মন্দিরে কী লাগল রাজনীতির রং! চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির উন্নয়ন কমিটির কার্যকরী সভাপতি সমীর ধল ও সহ-সভাপতি তেজেশচন্দ্র দেও ধবলদেব বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরে এমনই আশঙ্কা করছেন এলাকাবাসী। যোগদানের ঘটনা ঘিরে এলাকায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে।

কয়েকদিন আগেই ঝাড়গ্রামে এসে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির চত্বরের পরিকাঠামো উন্নয়নে ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপরে মন্দির কমিটির দুই কর্মকর্তা বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় উন্নয়ন-কাজ কীভাবে হবে তা নিয়ে ধন্দে রয়েছেন স্থানীয়রা।

গত ৭ অক্টোবর ঝাড়গ্রামে প্রশাসনিক সভায় প্রথমে মন্দিরের পরিকাঠামো উন্নয়নে ১ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সভা সেরে বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী গিয়েছিলেন চিল্কিগড়ে। মন্দিরে পুজো দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েছিলেন। মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে আরও ১ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা করেন তিনি।

ওই ২ কোটি টাকায় মন্দির চত্বরের পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রশাসনিক ভবন তৈরি সহ নানা কাজ হওয়ার কথা। অথচ মুখ্যমন্ত্রীর সেই ঘোষণার ছ’দিনের মাথায় গত মঙ্গলবার সমীর ধল ও তেজেশচন্দ্র দেও ধবলদেব বেলপাহাড়ির শিলদায় এক জনসভায় বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। ২০১৩-’১৮ পর্যন্ত তৃণমূলের ক্ষমতাসীন জামবনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি ছিলেন সমীর।

২০১৮-র পঞ্চায়েত ভোটে সমীর টিকিট পাননি। তবে তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত সমিতির আসনে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েও হেরে যান। অভিযোগ, তৃণমূলের একাংশ সমীরের স্ত্রীকে হারিয়ে দেন। তারপর থেকে রাজনৈতিক ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান সমীর। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি থাকাকালীন ২০১৪ সালে মন্দির উন্নয়ন কমিটির দায়িত্বে আসেন সমীর।

চিল্কিগড় রাজপরিবারের আরাধ্য কুলদেবী হলেন কনকদুর্গা। গহিন দুষ্প্রাপ্য গাছগাছড়ার জঙ্গলের মাঝে ডুলুং নদীর তীরে কনকদুর্গার মন্দিরটি একটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্রও।

মন্দির চত্বরের জঙ্গলটিকে ‘হেরিটেজ সাইট’ ঘোষণা করেছে পশ্চিমবঙ্গ জীব বৈচিত্র পর্যদ। তবে এর আগে সরকারি বরাদ্দে মন্দির চত্বরের পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজ নিয়ে খুশি নন রাজপরিবার।

আরও পড়ুন: অনুব্রত মন্ডলের সভাস্থলে হুলুস্থুল

১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামবনি পরগণার সামন্তরাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ। পরে গোপীনাথের দৈহিত্র কমলাকান্ত দেও ধবলদেব চিল্কিগড়ের রাজা হন। কমলাকান্তের উত্তরসূরিরা এখন মন্দিরের দায়িত্বে। ফলে মন্দির উন্নয়ন কমিটিতে চিল্কিগড় রাজ পরিবারের প্রভাব যথেষ্ট।

মন্দিরের প্রণামী, পর্যটক পিছু টিকিট, পার্কিং ফি থেকে মন্দির কমিটির যে আয় হয় তা দিয়েই মন্দির চত্বরের দেখভালের দায়িত্বে থাকা দশজন কর্মীর বেতন দেওয়া হয়। মন্দিরে সরাসরি প্রশাসনের হস্তক্ষেপ করার এক্তিয়ার নেই।

কয়েক বছর আগে মন্দির কমিটির অনুমতি সাপেক্ষে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদের টাকায় পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি কংক্রিটের হয়েছে।

মন্দির কমিটির দুই মাথা বিজেপিতে, থমথমে চিল্কিগড়
প্রতিবেদকের তোলা ছবি

বন দফতরের টাকায় মন্দির প্রাঙ্গণে শিশুদের পার্ক, পর্যটকদের বসার শেড, দোকান ঘর, বাহারি ফোয়ারা হয়েছে। কিন্তু সাবেক মন্দির প্রাঙ্গণের চিরাচরিত পরিবেশের মধ্যে ‘কংক্রিটের জঙ্গল’ তৈরি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে রাজ পরিবারে। তেজেশচন্দ্র বলছেন, ‘‘আমরা এতদিন চুপ ছিলাম। মুখ্যমন্ত্রী মন্দির সফরে এসে রাজ পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজনও বোধ করলেন না।

ওই দিন আমাকে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে যেতেও দেওয়া হল না। আমাদেরই মন্দির, অথচ আমাদের মতামত না নিয়ে বারে বারে উন্নয়নকাজ হয়েছে।’’ সমীরও বলছেন, ‘‘এর আগে উন্নয়নের নামে মন্দির চত্বরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যহানি হয়েছে।’’ তবে সমীর ও তেজেশচন্দ্রের বিজেপিতে যোগদানের পিছনে প্রাক্তন আইপিএস এক বিজেপি নেত্রীর হাত রয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

মুখ্যমন্ত্রীর মন্দিরের পরিকাঠামো উন্নয়নের টাকা বরাদ্দ করার পরে তড়িঘড়ি সমীর ও তেজেশচন্দ্রের গেরুয়াশিবিরে যাওয়ার পিছনে ভোট-রাজনীতির সমীকরণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

জামবনি পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি পুতুল শীট বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কনকদুর্গা মন্দির চত্বরের উন্নয়নের জন্য ২ কোটি টাকা বরাদ্দ করলেন, অথচ সমীর ও তেজেশ এটা কী করে বসলেন!’’ মন্দির চত্বরের অতিথিশালা ও ম্যারেজ হলের দায়িত্বে রয়েছে তৃণমূ‌ল পরিচালিত জামবনি পঞ্চায়েত সমিতি।

থমথমে চিল্কিগড়ে গিয়ে দেখা গেল, মন্দিরে পুজো চলেছে। মন্দির প্রাঙ্গণে গাছতলায় বসে রয়েছেন সমীর ও তেজেশচন্দ্র। দু’জনেই বলছেন, ‘‘মন্দিরে যাওয়ার রাস্তাটি বেহাল। আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। বার বার বলেও তো সে সব কাজ হচ্ছে না।’’

সমীর বলেন, ‘‘দু’কোটি টাকা বরাদ্দ ভোটের চমক নাকি সত্যিই কাজ হবে কি-না সেটা দেখার অপেক্ষায় রয়েছি।’’ তৃণমূলের নেতারা যদিও বলছেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যখন কথা দিয়েছেন কাজ হবে। বিজেপিতে গিয়ে কেউ বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করলে স্থানীয় মানুষ তা মেনে নেবেন না।’’

আরও পড়ুন ::

Back to top button