মতামত

শাস্ত্রে নবপত্রিকাকে বলা হয়েছে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

শাস্ত্রে নবপত্রিকাকে বলা হয়েছে 'নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা
উইকিপিডিয়া থেকে নেওয়া

মৃত্যুঞ্জয় সরদার, কলকাতা: আত্মবিশ্বাস এর উপরে নির্ভর করে চলছে সারা বিশ্বের সমাজব্যবস্থা। একটি ধর্মের একটি রীতি রেওয়াজ প্রচলিত আছে আজ পর্যন্ত। সেই সব ইতিহাসের নানান ব্যাখ্যা বারবার আমি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু সবকিছুর মধ্যে যেন একটি আত্মবিশ্বাস নির্ভরশীলতা প্রথা প্রাচীনকাল থেকেই আমরা মান্যতা দিয়ে আসছি। মান্যতা দেয়া ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায়ও নেই, পৃথিবীর বুকে খুজে পাওয়া যায়নি অন্য কোন বিকল্প শক্তি। বিজ্ঞান ও পারেনি এই শক্তির উৎস খুঁজতে।

প্রাকৃতিক যে শক্তি, যাকে আমরা কল্পতরু রূপে বিভিন্ন ধর্মের বিশ্বাস আত্মনির্ভরশীল ভরসার রক্ষাকর্তা, তিনি হচ্ছেন আল্লাহ, ভগবান ও গড। অদৃশ্য শক্তি আজ পৃথিবীর বুকে বিরাজমান। এই শক্তির উপরে নির্ভরশীলতা কোটি কোটি মানুষ। যে শক্তিটা আজও প্রচলিত এবং প্রচন্ড শক্তিশালী,তাকে আমরা ভগবান আল্লাহ গড যাই বলে ভরসা করে মনের সমস্ত কথা জানালে তিনি সে কাজেই সফলতা এনে দেয়।

তার বাইরেও প্রচলিত হয় নাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড।তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড হর্তাকর্তা বিধাতা, এই ব্রম্ভান্ডের মালিককে আমরা আজও মনে প্রানে ধন-সম্পদ সবকিছু সঁপে পূজা ও প্রার্থনা করি। এই পূজা বা পার্থনা বহু প্রাচীনকাল ধরতে প্রচলিত, আজ তা একই নিয়মে আমরা মেতে উঠি ।

আকাশে বাতাসে পুজো পুজো গন্ধ অনুভুতিতেই । বারবারই মনে হয় এই তো মা আসছেন। আর মাত্র কয়েকদিনের অপেক্ষা। ষষ্ঠীর সকালে বোধন দিয়ে শুরু হয় আচার অনুষ্ঠানের পর্ব। সপ্তমী থেকে দিন শুরু হয় পূজার্চনা। দুর্গাপুজোর আচার অনুষ্ঠান নিয়ে নানান বিধি রয়েছে। বেশি প্রশ্ন বা কৌতূহল রয়েছে গণেশের পাশে থাকা ‘কলা বউ’ বা ‘নবপত্রিকা’কে ঘিরে।

অনেকে মনেই প্রশ্ন থাকে, গণেশের পাশে ঘোমটা দেওয়া ওই গাছটি আদতে কী? এই বিষয়ে আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু, আর সে কথাগুলো আমি আমার কলমে তুলে ধরতে চাই পাঠকসমাজের কাছে।দুর্গাপুজোর অন্যতম আচার নবপত্রিকা স্নান। সপ্তমীর সকালে হয় স্নান। নবপত্রিকার আক্ষরিক অর্থ ‘নয়টি পাতা’।

যা নবপত্রিকা ন’জন দেবীর প্রতীক। কলা রূপে ব্রহ্মাণী, কচু রূপে কালিকা, হলুদ রূপে উমা, জয়ন্তী রূপে কার্তিকী, বেল রূপে শিবানী, দাড়িম রূপে রক্তদন্তিকা, অশোক রূপে শোকরহিতা, মান রূপে চামুণ্ডা এবং ধান রূপে লক্ষ্মী। শাস্ত্রে নবপত্রিকাকে বলা হয়েছে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা’।সেই কারনে নবপত্রিকাকে বাংলার দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ আমরা ধরে নিতে হয়। ‘নবপত্রিকা’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ নয়টি গাছের পাতা। তবে বাস্তবে নবপত্রিকা নয়টি পাতা নয়, নয়টি উদ্ভিদ।

রম্ভা ,কচ্চী, হরিদ্রাচ, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িমৌ। অশোক মানকশ্চৈব ধান্যঞ্চ নবপত্রিকা। অর্থাৎ: কদলী বা রম্ভা (কলা), কচু, হরিদ্রা (হলুদ), জয়ন্তী, বিল্ব (বেল), দাড়িম্ব (ডালিম), অশোক, মানকচু ও ধান। একটি সপত্র কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি সমূল সপত্র উদ্ভিদ একত্র করে একজোড়া বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়। তারপর সিঁদুর দিয়ে সপরিবার দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ।

নবপত্রিকা বা কলা বউ ইতিহাসের লুকিয়ে রয়েছে দেবী দুর্গার পূজিত ইতিকথা।গুপ্তযুগেও বাংলায় কোনও ব্রাহ্মণ ছিলেন না। সংস্কৃত ধর্মসূত্রের মন্তব্য স্মরণীয়: গৌড়ের লোকেরা দস্যু, সেখানে দিন কাটালে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। এ বার সেই কিংবদন্তি: রাজা আদিশূর কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণদের এই অজায়গায় নিয়ে এসে জমি দিয়ে বসত করান।ব্রাহ্মণরা এসে দেখলেন, এ দেশে জনজীবনের মূল উৎসব চৈত্র মাসে: গাজন। জাতিভেদ নেই, সারা গ্রাম একসঙ্গে ধর্মঠাকুরের পুজোয় মেতে ওঠে। এই ধর্ম নিতান্ত লৌকিক দেবতা, যুধিষ্ঠিরের বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই।

কিন্তু এই সর্বজনীন সামাজিক উৎসবে থাকবন্দি শাসনকাঠামো ধরে রাখা যাবে না। অতএব শুরু হল উচ্চবর্গের বিচিত্র অন্তর্ঘাত। প্রথমেই এল দুর্গাপুজো। কিন্তু সেই বাসন্তীপুজো গাজনের জনপ্রিয়তা কমাতে পারল না। ক্ষমতা গাজনকে বরাবর সন্দেহ করেছে। আজও মন্দিরগাত্রের টেরাকোটায় চড়কপুজোর উপস্থাপনা খুঁজে পাওয়া যায় না।চৈত্র হল বছরের দ্বাদশ মাস। তার উল্টো দিকেই ষষ্ঠ মাস: আশ্বিন। উত্তরাপথে নবরাত্রি সেই সময়।

রাজা সুরথ রাজ্য হারিয়ে বনে ঘুরছিলেন, মেধস মুনি সেই সময় তাঁকে শ্রীশ্রীচণ্ডী-র কাহিনি শোনান। রাজা দেবীর পুজো করে রাজ্য ফিরে পান। এ যে রাজধর্মের পুজো! সেই সংস্কৃত মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর মুখ্যত তিন অংশ। প্রথম অংশে ৩২টি শ্লোক, দেবী মধু ও কৈটভ দানবকে বধ করেন। দ্বিতীয় অংশে ১০৯টি শ্লোক, দেবী মহিষাসুরকে বধ করেন। তৃতীয় অংশ আরও বড়, ১৯৩টি শ্লোক। “বাংলা দুর্গাপুজোর শাস্ত্রীয় আচার এই ন্যারেটিভ কাঠামো মেনে তৈরি। সপ্তমীর থেকে অষ্টমী পুজো আরও দীর্ঘ, নবমী পুজো আরও বেশি সময়ের,” বলছিলেন র‌্যালফ নিকোলাস।

এই সংস্কৃত চণ্ডীর সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হল বাংলার চণ্ডীকে। মর্তে পুজো পাওয়ার জন্য কালকেতুকে রাজা করে দেন চণ্ডী। সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলা মঙ্গলচণ্ডী কী ভাবে মিশে গেল, দুর্গাপ্রতিমাই তার প্রমাণ। বাঙালির কাছে দুর্গা একই সঙ্গে অসুরনাশিনী, শিবের ঘরনি, কৈলাস ছেড়ে পিতৃগৃহে আসা কন্যা, কার্তিক, গণেশ এবং লক্ষ্মী, সরস্বতীর মা। গাঁজাড়ু স্বামীর ঘর করা সংস্কৃতে নেই। অসুরনাশিনী সেখানে লক্ষ্মীর মা এবং নারায়ণের শাশুড়িও নন।

গাজনের জন-উৎসবকে উৎখাত করতেই ‘ক্ষমতা’ সংস্কৃত পুরাণ এবং বাংলা লোককাহিনি মিলিয়ে শারদীয় পুজোর আখ্যান তৈরি করে।কিন্তু শরৎকালে পুজো হবে কী ভাবে? আষাঢ় মাসের শুক্লা একাদশীতে দেবতাদের রাত শুরু। ঘুম ভাঙে কার্তিক মাসের একাদশীতে। “ব্রাহ্মণ্যবাদ তখন অকালবোধন শুরু করে। স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্যর আগে অকালবোধনের কথা জানা যায় না। খেয়াল করবেন, লক্ষ্মী, কালী বা জগদ্ধাত্রী পুজোয় কিন্তু দেবীর ঘুম ভাঙানো হয় না,” জানাচ্ছেন র‌্যালফ।তবেই দুগা ক্ষমতার পুজো, জগদ্ধাত্রীও তা-ই।

বস্তুত দুর্গার তন্ত্রমন্ত্রে চার হাতের দেবীর যে বর্ণনা, তা জগদ্ধাত্রী রূপ। দশ হাতের দুর্গা মহিষাসুরনাশিনী, চার হাতের জগদ্ধাত্রী বধ করেন করিণ্ডাসুরকে। কালী বা চামুণ্ডাও অসুরকে ধ্বংস করেন। অসুরনাশই ক্ষমতায় একমাত্র কাম্য। তাই দেবী বিভিন্ন রূপকে একত্রে “নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা” নামে ” নবপত্রিকাবাসিন্যৈ নবদুর্গায়ৈ নমঃ মন্ত্রে পূজিতা হন।। একটি পাতাযুক্ত কলাগাছের সঙ্গে অপর আটটি গাছ মূল ও পাতাসহ একত্র করে একজোড়া বেল সহ সাদা অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে বেঁধে লালপাড় সাদা শাড়ি জড়িয়ে ঘোমটা দেওয়া বধূর আকার দেওয়া হয়।

তারপর তাতে সিঁদুর দিয়ে দেবীপ্রতিমার ডান দিকে দাঁড় করিয়ে পূজা করা হয়। প্রচলিত ভাষায় নবপত্রিকার নাম কলাবউ। আর না জেনে আমরা এটাকেই মনে করে আসছি গনেশের বউ।নবপত্রিকার পূজা প্রকৃতপক্ষে শস্যদেবীর পূজা।এদিকে আমার মত গবেষকদের মতে, “এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই প্রকৃতি রূপিনী শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। … বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।

তবে অনেক পুরাণ বিশেষজ্ঞের মতে দেবীপুরাণে নবদুর্গা আছে, কিন্তু নবপত্রিকা নাই।… নবপত্রিকা দুর্গাপূজার এক আগন্তুক অঙ্গ হইয়াছে।… বোধ হয় কোনও প্রদেশে শবরাদি জাতি নয়টি গাছের পাতা সম্মুখে রাখিয়া নবরাত্রি উৎসব করিত। তাহাদের নবপত্রী দুর্গা-প্রতিমার পার্শ্বে স্থাপিত হইতেছে ।তবে উল্লেখ্য, মার্কণ্ডেয় পুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ নেই। কালিকাপুরাণে নবপত্রিকার উল্লেখ না থাকলেও, সপ্তমী তিথিতে পত্রিকাপূজার নির্দেশ রয়েছে। কৃত্তিবাস ওঝা বিরচিত রামায়ণে রামচন্দ্র কর্তৃক নবপত্রিকা পূজার উল্লেখ রয়েছে – “বাঁধিলা পত্রিকা নব বৃক্ষের বিলাস।”

শাস্ত্রে নবপত্রিকাকে বলা হয়েছে 'নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা
ফাইল ছবি

মহাসপ্তমীর দিন সকালে নিকটস্থ নদী বা কোনো জলাশয়ে (নদী বা জলাশয়ে ) নিয়ে যাওয়া হয়। পুরোহিত নিজেই কাঁধে করে নবপত্রিকা নিয়ে যান। তাঁর পিছন পিছন  শোভাযাত্রা সহকারে ঢাকীরা ঢাক বাজাতে বাজাতে এবং মহিলারা শঙ্খ ও উলুধ্বনি করতে করতে যান। শাস্ত্রবিধি অনুযায়ী স্নান করানোর পর নবপত্রিকাকে নতুন শাড়ি পরানো হয়। তারপর দোলাতে বা পাল্কীতে চাপিয়ে পূজামণ্ডপে নিয়ে এসে পুরনারীদের দিয়ে বরণ করানোর পর নবপত্রিকাকে দেবীর ডান দিকে একটি কাঠে সিংহাসনে স্থাপন করা হয়।

পূজামণ্ডপে নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে দুর্গাপূজার মূল অনুষ্ঠানটির প্রথাগত সূচনা হয়। অন্যদিকে চন্দননগরের মণ্ডলবাড়িতে অবশ্য বোধন হয় প্রতিপদে। তখন থেকেই প্রতিদিন দেবীর পুজো হয়, রোজ হয় সন্ধ্যারতি। সকালে ভোগ, রাতে শীতল। বাড়ির নিয়ম তেমনই। তবে ব্যতিক্রম শুধুমাত্র পুজো শুরুর তিথিতে নয়, মণ্ডলবাড়ির পুজোয় এমন অনেক বৈশিষ্ট্য আছে যা বিরল। এমন রীতি আমার অন্তত জানা ছিল না।মহাসপ্তমীর পুজোর সময় এই বাড়িতে জ্বলে হোমাগ্নি, তা নির্বাপিত হয় মহানবমীতে, এটাই রীতি।সাধারণ ভাবে নবপত্রিকা, মানে যাকে কলাবউ বলা হয়, তিনি হলেন দেবী দুর্গা।

তবে এই বাড়িতে নবপত্রিকাকে যে নিয়মে পুজো করা হয়, তাতে তিনি দেবী দুর্গা নন, তিনি গণেশের স্ত্রী, মানে দেবী দুর্গার পুত্রবধূ। এটিও এই বাড়ির পুজোর আরেক বৈশিষ্ট্য।হঠাৎ করে নবপত্রিকার পুজো প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে মন্ডলবাড়ী কথা উল্লেখ করলাম কেন? মন্ডল বাড়ির পূজার নবপত্রিকা কে যেভাবে গণেশের স্ত্রীরূপে পূজা করা হয়, বাংলা তথা ভারতবর্ষের এমনই পূজা হয়না ।তাই মন্ডল বাড়ির কথাটি এই লেখাতে উল্লেখ করলাম এবং তার বিস্তারিত বলার চেষ্টা করছি।১৭৪১ সালে তৈরি হয় মণ্ডলবাড়ি। প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকেই আঙিনা, সেখান থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দালান, তা পেরিয়ে ঠাকুরদালান।

এখানেই দেবীপক্ষে টানা দশ দিন পুজিতা হন দেবী দুর্গা, পুজো শুরু হয় প্রতিপদ থেকে। নেলিনের কথায়, “পুজো আগেও হত, তবে এই ভাবে প্রতিমা পুজো শুরু হয় ১৮২৫ সালে। তার আগে হত ঘটপুজো। সেই হিসাবে এই পুজো ১৯৩ বছরের পুরোনো। এই পুজো মোটেই ৩০০ বছরের পুরোনো নয়।” তিনি জানালেন এই রাজ্যে সবমিলিয়ে দশটি বাড়িতেও প্রতিপদে পুজো শুরু হয় না। এক সময় এই বাড়ির পুজোয় এক হাজার পুরোহিত আসতেন। পুজোর ব্যাপ্তিও ছিল ব্যাপক। সময়ের সঙ্গে সেই জৌলুস কমেছে।

সময় বোঝানের জন্য একটি তথ্য দিয়ে রাখা দরকার: ১৭৩০ সালে চন্দননগরের গভর্নর নিযুক্ত হন যোশেফ ফ্রাঁসোয়া দুপ্লে। যাক এসব কথা, সেই বাড়িতে আমার মত লেখোকের দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো অনেক ছোটবেলাতে।মণ্ডলবাড়িতে ঢোকার মুখে জানলার দিকে তাকালে চোখে পড়বে দাড়িওয়ালা মুখ – বাড়িটিতে ইউরোপের একাধিক দেশের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য নজর কাড়ে। জৌলুস ও ঔজ্জ্বল্য হারালেও স্বাতন্ত্র্য রয়েছে এই বাড়ির। স্বাতন্ত্র্য রয়েছে পুজোরও।মূল আঙিনায় দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে দেখা যাবে দড়িতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নানা ধরনের ফল, ফলের থোকা।

এমন রীতি আগে কখনও দেখিনি। এমন কেন? নেলিন মণ্ডল শোনালেন এই রীতির নেপথ্যকথা:তবে দুগ পুজোর কয়েকটি সঙ্গে মিল রয়েছে মধ্য এশিয়ার নানা অঞ্চলের, এমনকি আবিসিনিয়া (সাবেক ইথিয়োপিয়া সাম্রাজ্য) এবং অধুনা আফগানিস্তানের প্রাচীন কয়েকটি রীতির। তারই মধ্যে একটি হল এই ফল ঝুলিয়ে রাখা। এই সময় অনেক আত্মা মর্ত্যে নামে, অশুভ আত্মাকে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না, তাই আগেই খাবার দিয়ে দেওয়া হয়।

যদি দড়ি থেকে কোনও ফল পড়ে যায় তা হলে ধরে নেওয়া হয়, আত্মা সেই ফল গ্রহণ করেছে, ফল বেঁধে নতুন করে সেই জায়গায় তা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। আর শুভ আত্মার জন্য তো নানাবিধ ভোগের আয়োজন করা হয়েই থাকে। সব আত্মাকে ফেরালে চলবে কেন! এই হচ্ছে মন্ডল বাড়ির ইতিহাস। একথা বলার সাথে সাথে প্রাচীনকালের মায়ের আরাধনা বহু ইতিহাস রয়ে গেছে, যা লিখলে রামায়ণ ও মহাভারতের মত কাব্যগ্রন্থ হয়ে যাবে। তবে দুর্গাপূজার সঙ্গে যে পৌরাণিক কাহিনী জড়িত, তার উৎস বিষ্ণু ধর্মোত্তর পুরাণ, মৎস্যপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ, দেবী ভাগবত, কালিকাপুরাণ ইত্যাদি।

শিব আর ব্রহ্মার বরে কোনো পুরুষের অজেয় ও ত্রিলোকবিজয়ী এই মহিষাসুরের অত্যাচারে স্বর্গচ্যুত দেবতাদের কাতর প্রার্থনায় আবির্ভূতা তাঁদেরই সম্মিলিত তেজসম্ভূতা দেবী দুর্গার সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হয় সে। রাময়ণের নায়ক রামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী সীতাকে রাবণের বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার মানসে শরৎকালে দেবী দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, সেই থেকে শারদীয়া দুর্গাপূজার সূচনা হয়, এমন উল্লেখ কোথাও কোথাও পাওয়া যায়।

আবার তারও আগে বসন্তকালে রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধি নিজেদের সৌভাগ্যকামনায় দুর্গাপূজা করেছিলেন, এ রকম পৌরাণিক কাহিনীও প্রচলিত আছে। বাঙালি কবি কালিদাস তাঁর রামায়ণে শরৎকালের দুর্গাপূজাকে অকালবোধন বলে উল্লেখ করেছেন, যদিও প্রাচীনতর মার্কণ্ডেয় পুরাণে শরৎকালই দুর্গাপূজার সময় বলে উল্লিখিত। আবার বাল্মিকী রামায়ণে কিন্তু কোথাও রাম দুর্গার আরাধনা করেছিলেন বলে পরিষ্কার উল্লেখ নেই!এদিকে দুর্গাপুজোর পৌরাণিক পটভূমি যা-ই হোক, এর ইতিহাস যে বেশ প্রাচীন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিতে দ্বাদশ শতকে বারেন্দ্রীতে দুর্গাপূজার সবচেয়ে পুরানো উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত দুর্গা আরাধনার তত্ত্ব ও দুর্গামূর্তির রূপকল্পনা – সব কিছুতেই অনেক বিবর্তন হয়েছে। দেবী দুর্গার আরধনার মধ্যে কৃষি নির্ভর সমাজের পৃথিবীকে অর্থাৎ ভূমিকে ফলে-শস্যে সম্পদবতী করে তোলার প্রার্থনাই রূপায়িত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। তাঁদের মতে পূজার সময়ে দুর্গা মূর্তির সঙ্গে সুসজ্জিতা নবপত্রিকার [যা আদতে ন’ রকম ফল সমেত শাড়ি পরানো একটি কলাগাছ] স্থাপনাতে সেই চিন্তাই অভিব্যক্তি পেয়েছে।

অন্যদিকে ইতিহাসবিদ ও পুরাতাত্ত্বিকেরা আবার দুর্গাপূজার মধ্যে অন্য একটি রূপকের সন্ধান পান। বহিরাগত আর্যরা অনার্য অধ্যুষিত ভারতবর্ষে যুদ্ধ ও সামাজিক সংঘাতের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিলেন, এ কথা যদি মেনে নেওয়া যায়, তা হলে এটা খুবই সম্ভব যে, কৃষিপারঙ্গম আর্যরা এসে আদিম বঙ্গভূমির এমন কোনো সমাজের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল, যার কুলপ্রতীক বা টোটেম ছিল মহিষ।

শস্যশালিনী পৃথিবীস্বরূপা দুর্গার হাতে মহিষাসুরের নিধনের মধ্যে কি রূপায়িত হয়েছে কৃষিকুশল আর্যদের কাছে আদিম বাংলার কৌম সমাজের নতিস্বীকারের ঘটনা? নবপত্রিকার পূজার মধ্যেও কি সেই কৃষিপরায়ণ আর্যদেরই আধিপত্য বিস্তারের ইঙ্গিত? অসম্ভব নয়। তা ছাড়া দুর্গার মহিষাসুর নিধন আর রামচন্দ্রের রাবণকে পরাভূত করার কাহিনী, এ দুয়ের মধ্যে একটি সাদৃশ্যও লক্ষণীয়।

মহিষাসুর ও রাবণ – দু’জনের উদ্ভবের মূলেই রয়েছে শিবের বরপ্রাপ্তি-যে শিব মূলত অনার্য দেবতা। অর্থাৎ এমনটা হতেই পারে যে, দুর্গাপূজার প্রচলনের মধ্য দিয়ে অনার্যদের পরাভবের কাহিনীই রূপায়িত হয়েছে।আমরা দেবী দুর্গার পুজার সময়ে নির্মিত আধুনিক মূর্তির যে বিবরণ শুরুতেই উপস্থিত করেছি, তার মূলে রয়েছে বিভিন্ন পুরাণ ও শাস্ত্রের বর্ণনা। এই সব পুরাণ, শিল্পশাস্ত্র ও ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী দশভুজা ও দশপ্রহরণধারিনী, সিংহবাহিনী তথা অসুরবিনাশিনী।

আবার হেমাদ্রির বর্ণনা অনুযায়ী তিনি বিংশতিভুজা আবার শিল্পরত্নের কল্পনায় তিনি ত্রিনয়নী, জটাজুটসংযুক্তা, নীলকমলসদৃশ তাঁর চোখ, তিনি পীনোন্নতপয়োধরা ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনো মন্ত্রের বর্ননায় আবার তিনি তপ্তকাঞ্চণবর্ণা,তাঁর মুখ পূর্ণচন্দ্রের মতো — তাঁর মাথায় অর্ধচন্দ্র, তাঁর হাতে নানা আয়ুধ ও ঘন্টা, তাঁর অস্ত্রে নিপাতিত অসুর।ঠিক একই প্রথা মেনে সর্বাগ্ৰে নবপত্রিকা বিসর্জনের পরই দেবী দুর্গার মৃণ্ময়ী মূর্তি বিসর্জন হয়ে থাকে।

 

আরও পড়ুন ::

Back to top button