মতামত

বিংশ শতাব্দীর বেড়ে ওঠা ভারতীয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

বিংশ শতাব্দীর বেড়ে ওঠা ভারতীয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস - West Bengal News 24

২৩ শে জানুয়ারি নেতাজির জন্ম দিবস উপলক্ষে ভারত বর্ষ তথা বাংলাদেশ এবং বিশ্বের ইতিহাসে বিখ্যাত দিন হিসেবে ঘোষণা আছে। যে মানুষটি দেশকে মায়ের আসনে বসিয়ে তার প্রতি সীমাহীন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার কারনেই ব্রিটিশ শাসকের মাটিতে দাঁড়িয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে, স্বপ্ন দেখতে পেরেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, আমাদের অতি আদরের, পরম কাছের, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস। কতটা ভালোবাসা আর আবেগ বুকের মধ্যে জমানো থাকলে একজন মানুষ নিজের নিশ্চিত মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে, স্বপ্ন দেখতে পারেন এমন এক স্বাধীন ভারতের, যার সবুজ বুকে থাকবে উদীয়মান লাল সূর্য, আর তাকে ঘিরে থাকবে প্রকৃতির নির্মল ছায়া – সেটা সত্যিই কল্পনার অতীত।

আজ স্বাধীন ভারতবর্ষের গর্বিত ভারতীয়রা খোলা হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছে, দিনের জন্মের সাথে পুব আকাশে রবির কিরণ শরীরে নরম পরশ দিয়ে যাচ্ছে, সে তো এইসবই ভারত মাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্য। কেমন ছিল এইসব ক্ষণজন্মা মহাপুরুষদের বাল্যকাল ? কেমন মায়ের গর্ভে জন্মেছিলেন এই সিংহ হৃদয় পুরুষ? আজ তাঁর জন্ম বার্ষিকীতে একবার তাঁর বাল্যকালে ঘুরে আসতে ক্ষতি কি? বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বেড়ে ওঠা ভারতীয় তরুণদের দিনগুলো কাটতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের এক দোলাচলে। সেই সময় ভারতীয় সমাজে একদিকে যেমন প্রাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার হতে থাকে, ঠিক অন্যদিকে প্রাশ্চাত্যের ছাঁচে গড়ে উঠতে থাকে ভারতীয় মন। কলকাতার বন্দরকে ঘিরে ওঠা সমৃদ্ধ শহরটিতে বাঙালি মধ্যবিত্ত মনেও তখন নাড়া দিয়েছে ইংরেজ শিক্ষা। বাঙালি বহিরাবরণ পরিহিত আধা ইংরেজ হয়ে যাচ্ছে না তো সবাই! রাজা রামমোহন রায় থেকে শুরু করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সব সচেতন ব্যক্তি তখন বাঙালি সমাজকে আঁকড়ে ধরে থাকা কুসংস্কারকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। দেশীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার জন্য, বিশ্বের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করার জন্য পশ্চিমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা কিংবা ইংরেজি ভাষা শিক্ষা দোষের কিছু নয়, এই ধারণা বাঙালি সমাজে বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম পথিকৃত জগদীশ চন্দ্র বসু সহ অনেক বাঙালির মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিলো। এমনই দ্বিধাবিভক্ত ভারতে জন্ম নিলেন সুভাষচন্দ্র বসু।

ভারতের ওড়িশা রাজ্যের কটক শহরে ১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয়। তাঁর বাবার নাম জানকীনাথ বসু ও মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। বাবা ও মায়ের চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নেতাজি ছিলেন নবম সন্তান। ১৯০২ সালে প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় বিদ্যালয়ে তাঁর প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয়। বর্তমানে এই স্কুলটি স্টুয়ার্ট উচ্চবিদ্যালয় নামে পরিচিত। এরপর ১৯০৯ সালে তিনি রাভেন’শ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে তিনি ম্যাট্টিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই সময়টায় তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ’র বাণী দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন ও জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। প্রেসিডেন্সি কলেজের এক ইংরেজ প্রফেসরের ভারত বিদ্বেষী মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে সুভাষ তাঁর উপর আক্রমণ করেছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি খুব অল্প সময়ের জন্য পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনশাস্ত্র বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯১৯ সালে বাবার ইচ্ছায় সুভাষ ইংল্যান্ড রওনা হন ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (ICS) পরীক্ষা দেবার জন্য। সেখানে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় তিনি চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং চাকরির নিয়োগ পত্র পেয়েও কেবল ব্রিটিশদের দাসত্ব করবেন না বলে তিনি তা ত্যাগ করে ১৯২১ সালে ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে ফিরে তিনি তৎকালীন পরিস্থিতি নিয়ে ‘স্বরাজ’ নামক পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করেন এবং এর মধ্যে দিয়েই তাঁর রাজনৈতিক জীবনে অনুপ্রবেশ ঘটে। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতা পৌরসভার মেয়র থাকাকালীন সুভাষ তাঁর অধীনে কাজ শুরু করেন। কংগ্রেসের সক্রিয় সদস্য চিত্তরঞ্জন দাশকেই সুভাষের রাজনৈতিক গুরু মনে করা হয় যিনি সেই সময়কার বাংলার জাতীয়তাবাদের মুখপাত্র ছিলেন। ১৯২৫ সালে সুভাষকে অন্যান্য আন্দোলনকারীদের সাথে গ্রেফতার করে মান্দালয় জেলে পাঠানো হয়। ১৯২৭ সালে কারাগার থেকে মুক্ত হলে সুভাষকে কংগ্রেস দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয় এবং তিনি জওহরলাল নেহরুর সাথে কাজ করতে শুরু করেন। ১৯৩০ সালে সুভাষ ইউরোপ যাত্রা করেন। ইউরোপে থাকাকালীন সময়ে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে “ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল” নামে একটি বই রচনা করেন যেটি ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হলেও এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন দেশগুলিতে এই বইয়ের প্রভাবে অশান্তির ভয়ে বইটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯৩৮ সালে সুভাষ প্রথমবার জাতীয় কগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৩৯ সালে সুভাষ দ্বিতীয়বার জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে মহাত্মা গান্ধী তাঁর বিরোধিতা করেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দলটি বিভক্ত হয়ে যায়। সুভাষ কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করে ‘অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক’ গঠন করেন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশদের সাথে যুদ্ধে যোগ দিলে সুভাষ হতাশ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ পুলিশ এই সময় সুভাষকে ঘরবন্দি করে রাখলে তিনি গোপনে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ছদ্মবেশে আফগানিস্তান ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যান এবং সেখানে গিয়ে হিটলারের কাছে ভারতের স্বাধীনতার জন্য সাহায্য প্রার্থনা করেন। হিটলারের কাছ থেকে কোন সাহায্য না পেয়ে তিনি জার্মানি থেকে গোপন পথে ১৯৪৩ সালে জাপানে এসে পৌঁছান। জাপানিদের সহযোগিতায় রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে জাপানে ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) গড়ে উঠেছিল যার দায়িত্ব রাসবিহারী বসু নেতাজির হাতে তুলে দেন। নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই দলের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৫,০০০ এর মত। ‘ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী’ নাম বদলে এই বাহিনীর নাম রাখা হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে জাপান আত্মসমর্পণ করলে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়ে! ১৯৪৫ সালের ১৮ই আগস্ট  সুভাষ তাইহোকু বিমানবন্দর থেকে বিমানে জাপান ত্যাগ করার পর এই বিমানটি দুর্ঘটনায় পরে এবং দুর্ঘটনায় সুভাষের মৃত্যু হয় বলে মনে করা হয় যদিও সুভাষের প্রকৃত মৃত্যুর কারণ আজও জানা যায়নি বা সরকার কর্তৃক জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়নি। এদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে ‘দেশনায়ক’ আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাঁকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: “স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।”

এই উদ্যোগের অংশরূপেই তৈরী হয় ‘দি ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ [The Indian Legion], জার্মান ভাষায়: ‘ইন্দাশে লিজিয়ন’ [Indische Legion]; এর সরকারী নাম ছিল ‘ফ্রি ইন্ডিয়ান লিজিয়ন’ [Free Indian Legion]। নাৎসি জার্মানির এই ইউনিটটি ভারতীয় সৈন্যদের নিয়ে তৈরী হয়েছিল। এছাড়াও কিছু জার্মান সরকারী অফিসার ও বেশ কিছু ভারতীয় অফিসারদের নিয়ে বার্লিনে জার্মান সরকার কর্তৃক নির্মিত হয় এক মেকানিজম, যার নাম ছিল ‘স্পেশ্যাল ব্যুরো ফর ইন্ডিয়া’ [Special Bureau for India]। এই ইন্ডিয়ান লিজিয়নের ভারতীয় সৈন্যরাই সর্বপ্রথম সুভাষ চন্দ্র বসুকে ‘নেতাজী’ বলে সম্বোধন করেন ১৯৪২ এর শুরুর দিকে, আর পরবর্তীকালে ‘স্পেশ্যাল ব্যুরো ফর ইন্ডিয়া’-এর সদস্য অফিসাররাও তাঁকে একই নামে সম্ভাষন করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে সমগ্র ভারত ও পৃথিবীর সমস্ত ভারতীয়দের মধ্যেই তাঁর এই উপাধিটি প্রবল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

সেখান থেকেই নেতাজি সম্মাননা আখ্যায়িত হয়। আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাঁকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামে ও ওডিশায় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তাঁর নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তাঁর নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তাঁর নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: ‘নেতাজি ভবন’ (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও ‘নেতাজি’ (পূর্বনাম কুঁদঘাট) অন্যদিকে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের উত্তরাধিকার প্রতিটি জাতীয়তাবাদী ভারতবাসীর। তাই আজ যখন ২১শে অক্টোবরের দিনটি জাতীয় স্বীকৃতি পায় তখন তা জাতীয়তাবাধী ভারতবাসীর কাছে অত্যন্ত আনন্দের দিন। বিশেষত দিনটিতে যখন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী প্রথা ভেঙে লালকেল্লায় দ্বিতীয়বারের জন্য জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

এইখানেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বাহবা প্রাপ্য। তিনি তাঁর উত্তরসূরীদের অনুসরণ করে শুধুমাত্র একটি বিশেষ পরিবারের প্রতি আনুগত্য দেখাননি। তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সব থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের প্রতি যোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে একটি বিশেষ দিনকে জাতীয় স্বীকৃতি দিয়েছেন। নিন্দুকদের এক্ষেত্রে জেনে রাখা ভালো ২১শে অক্টোবরের আজাদ হিন্দ দিবস নরেন্দ্র মোদী এই প্রথমবার পালন করলেননা। এর আগে ২০১২ সালেও তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে গুজরাটে এই দিনটির জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। এছাড়াও নেতাজী সংক্রান্ত বেশ কিছু ফাইল যা পূর্ববর্তী সরকারগুলি তালাবন্ধ রেখেছিল তাও তিনি প্রকাশ করে জনসমক্ষে এনেছেন। কাজেই নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শনে তিনি বরাবরই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন এবং এই সম্মান প্রদর্শনে অন্য কারুর কারুর মতো হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে নেতাজী আমার না তোমার এই খেলাতেও নামেননি। দিনটি তিনি পালন করেছেন ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে, দলীয় কার্যকর্তা হিসাবে নয়। সেই কারণেই আজ তিনি বাম এবং কংগ্রেসী ঐতিহাসিকদের চক্ষুঃশূল হলেও ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের বাহবা পাচ্ছেন। এদিকেই ফরোয়ার্ড ব্লক বিশ্বাস না করতে পারে নেতাজী এমিলিকে বিবাহ করেননি। এখনও সেই বিতর্ক তারা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু কৃষ্ণা বসু ও তাঁর ‘নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো’-তে রাখা নেতাজীর সহস্তে লেখা চিঠি স্পষ্ট বলে দিচ্ছে। হ্যাঁ, নেতাজি বিবাহ করেছিলেন। তাঁদের মেয়েই অনিতা বসু। বিবাহের পরে যিনি অনিতা পাপ। সেই চিঠিতে স্ত্রী কন্যার বসু পরিবারে স্বীকৃতি চেয়েছিলেন সুভাষ।

বিতর্কের অন্যতম কারণ হিসাবে অনেকক্ষেত্রেই একটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে। কি সেই কারণ? বলা হচ্ছে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৯ সালের ২৩ নভেম্বর চীন ভ্রমণের ভিসার আবেদনপত্রে উল্লেখ করেছেন তিনি অবিবাহিত আর স্বহস্তে স্বাক্ষর করেছেন।(পশ্চিমবঙ্গের রাজ‍্য মহাফেজখানার নথি – নং ৫২৪/৩৯)। কিন্তু কৃষ্ণা বসুর লেখা ‘আ ট্রু লাভ স্টোরি-এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’ বইতে স্পষ্ট লেখা হয়েছে নেতাজী ও এমিলি ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর বিবাহ করেছিলেন। এই তথ্য তারা অনেক পরে জানতে পারেন। যারা এই তথ্য বিশ্বাস করেন না , বা এই তথ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন তাদের নেতাজীর নিজের হাতের লেখা চিঠি ধন্ধে ফেলতে পারে। চিঠিতে সুভাষ তাঁর ফিরে না আসার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। স্পষ্ট লিখেছেন তাঁর বিবাহ ও মেয়ের কথা। লিখেছেন যেন তিনি না থাকলে তাঁর স্ত্রী ও মেয়েকে যেন গ্রহন করে তাঁর পরিবার। এই চিঠিই তাঁর লেখা শেষ চিঠি যা তিনি দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র বসুকে। কি লেখা আছে সেই চিঠিতে? বার্লিন ৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ সালে সুভাষ তাঁর মেজদাদা শরৎচন্দ্র বোসকে লিখেছেন , ‘আজ পুনরায় আমি বিপদের পথে রওনা হইতেছি। এবার কিন্তু ঘরের দিকে। হয় তো পথের শেষ আর দেখিব না। যদি তেমন বিপদ পথের মাঝে উপস্থিত হয় তাহলে ইহজীবনে আর কোনও সংবাদ দিতে পারিব না তাই আমি আমার সংবাদ এখানে রাখিয়া যাইতেছি। – যথা সময়ে এই সংবাদ তোমার কাছে পৌঁছিবে।’ এরপরেই নিজের স্ত্রী ও মেয়ের কথা উল্লেখ করেছেন নেতাজী। তিনি লিখেছেন, ‘আমি এখানে বিবাহ করেছি এবং আমার একটি কন্য হইয়াছে। আমার অবর্তমানে আমার সহধর্মিণী ও কন্যার প্রতি একটু স্নেহ দেখাইবে – যেমন সারা জীবন আমার প্রতি করিয়াছ। আমার স্ত্রী ও কন্যা আমার অসমাপ্ত কার্য শেষ করুক – সফল ও পূর্ণ করুক – ইহাই ভগবানের প্রতি আমার শেষ প্রার্থনা।’

চিঠির শেষে লেখা রয়েছে । ‘আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহন করিবে – মা , মেজ বৌদি এবং অন্যান্য গুরুজনকে ইতি তোমার স্নেহের ভ্রাতা সুভাষ।’এবার বিতর্ক এখানেও থামতে না পারে কারণ এখানে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নাম উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি অনেকেই বলতে পারেন কি প্রমাণ রয়েছে ওই লেখা নেতাজীরই। তবে তো প্রশ্ন উঠতে পারে নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো এবং কৃষ্ণা বসুর লেখা বই নিয়ে। প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। তবু বাস্তব তো বাস্তবই হয়। কৃষ্ণা বসুর সন্তান প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সুগত বসুর লেখা ‘হিজ ম্যাজেস্টিজ অপোনেন্ট-সুভাষ চন্দ্র বসু অ্যান্ড ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল এগেইনস্ট এম্পায়ার’-এ লিখেছেন, এমিলির সঙ্গে সাক্ষাতের পরেই সুভাষের জীবনে একটা নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল। দুজনের মধ্যে প্রেমপত্র বিনিময় হত। এমিলিকে উদ্ধৃত করে সুগত বসু তার বইতে লিখেছেন, প্রেমের আভাসটা সুভাষ চন্দ্র বসুর দিক থেকেই এসেছিল। ১৯৩৪-এর মাঝামাঝি সময় থেকে পরের বছর দু’য়েক অস্ট্রিয়া আর চেকোস্লোভাকিয়াতে থাকার সময় সম্পর্কটা আরো মধুর হয়ে উঠেছিল। যুদ্ধের সময়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য সাহায্য পাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপের মধ্যে সুভাষচন্দ্র নিজের প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতেন। তারপর চিঠিতে উঠে আসে দু’জনের আবেগঘন কথোপকথন।

সুভাষ চন্দ্র এক চিঠিতেই লিখেছিলেন, ‘আমি জানি না ভবিষ্যতে কী হবে। হতে পারে, পুরো জীবনটাই হয়তো জেলে কাটাতে হবে, অথবা আমাকে গুলি করা হবে, কিংবা ফাঁসিও হতে পারে। এও সম্ভব যে তুমি হয়তো আমাকে কখনো আর দেখতেই পাবে না, অথবা আমি হয়তো কখনো তোমাকে চিঠিও লিখতে পারব না। কিন্তু ভরসা রেখো, তুমি চিরকাল আমার হৃদয়ে থাকবে, আমার মনে, আমার স্বপ্নে থাকবে। যদি এই জীবনে সম্ভব না হয়, তাহলে পরের জীবনে তোমার সঙ্গেই থাকব আমি।’এই চিঠি দেওয়া-নেওয়ার পালার মাঝেই যেবার এমিলি আর সুভাষের দেখা হয়েছিল, তখনই তারা বিয়ে করেন। ১৯৩৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর তাদের বিয়ে হয়েছিল অস্ট্রিয়ার বাদগাস্তিনে। দুজনেরই পছন্দের রিসর্ট ছিল ওটা। তবে দুজনেই নিজেদের বিয়ের ব্যাপারটা গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই অজানা কথাই লেখা রয়েছে ড. কৃষ্ণা বসুর ‘আ ট্রু লাভ স্টোরি-এমিলি অ্যান্ড সুভাষ’।

আরও পড়ুন ::

Back to top button