জানা-অজানা

যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে মিথ্যাচারী ছিলেন

যুক্তরাষ্ট্রের কোন প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে মিথ্যাচারী ছিলেন - West Bengal News 24

ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল তিনি সত্যের ধার ধারেন না, নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলেন। কিন্তু সত্যটা হলো হোয়াইট হাউজে ট্রাম্পের পূর্বসূরিদের অনেকেই অবিশ্বাস্য মাত্রায় ভয়াবহ রকমের মিথ্যাচার করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো তাদের সাথে কি ট্রাম্পের তুলনা আসলেই হতে পারে?

অবশ্যই পারে। যেমন, সাদ্দাম হোসেন যখন ১৯৯০ সালের আগস্টে কুয়েত দখল করেন, প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ (বুশ সিনিয়র) হুমকি দিয়েছিলেন, ‘এটা সহ্য করা হবেনা’ কিন্তু আমেরিকা যখন উপসাগরে সৈন্য সমাবেশ করল, মার্কিন জনগণের যুদ্ধে তেমন সায় ছিল না।

নির্বাসিত কুয়েত সরকার তখন যুদ্ধের পক্ষে আমেরিকায় জনমত তৈরিতে দ্রুত মার্কিন একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান (হিল অ্যান্ড নোলটন) নিয়োগ করে। বুশের সাবেক প্রধান সহকারী তখন ওয়াশিংটনে প্রতিষ্ঠানের অফিসটি চালাতেন।

ওই জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানটি ‘নাইরা’নামে ১৫ বছরের একজন কিশোরীকে ইরাকি আগ্রাসনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে প্রশিক্ষণ দেয়।

এরপর ওই কিশোরী ছলছল চোখে ১৯৯০-এর অক্টোবরে মার্কিন কংগ্রেস সদস্যদের সামনে বলে যেন কীভাবে ইরাকি সৈন্যরা কুয়েতের একটি হাসপাতাল ঢুকে ইনকিউবেটর থেকে সদ্যোজাত অসুস্থ শিশুদের বের করে নিয়ে তাদেরকে মেঝেতে শুইয়ে রেখেছিল যাতে তারা মারা যায়।

সাংবাদিকদের বলা হয়েছিল নাইরা নামটি ছদ্মনাম, কারণ আসল নাম প্রকাশ পেলে কুয়েতে তার পরিবারের ওপর নির্যাতন হতে পারে। যুদ্ধের পর জানা যায়, ওই কিশোরী ছিল যুক্তরাষ্ট্রে কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের মেয়ে এবং সে যা বলেছিল তা পুরোপুরি মনগড়া।

প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধ নিয়ে জন ম্যাকআর্থার তার এক বইতে ওই ঘটনার বিস্তারিত লিখেছেন। সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর যুক্তি হিসাবে বুশ নিজে কমপক্ষে ছয়বার কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের মেয়ের মুখের ওই কল্পকাহিনী জনসমক্ষে উল্লেখ করেছেন।

সৌদি আরবে মার্কিন সৈন্যদের সামনে এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘ইনকিউবেটর থেকে শিশুদের বের করে কাঠের চেলার মত মেঝের ওপর ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।’

ম্যাকআর্থার লিখেছেন, ‘সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধের সামরিক অভিযানে সমর্থন তৈরিতে ওই মনগড়া গল্প কাজে লেগেছিল।’

১৯৯১ সালে জানুয়ারিতে সেনেটে বুশের যুদ্ধ শুরুর প্রস্তাব খুব অল্প ব্যবধানের ভোটে পাশ হয়। ছয়জন সিনেটর তাদের দেয়া সমর্থনের যুক্তিতে হাসপাতালে ইনকিউবেটর থেকে শিশুদের টেনে বের করার সেই মনগড়া কাহিনীর উল্লেখ করেছিলেন।

কয়েকদিন পরই অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম শুরু হয়েছিল।

দুঃখের বিষয় যেটি ছিল তা হলো হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে সরানোর জন্য সত্যিই শিশুদের মৃত্যু হয়েছিল, কিন্তু তা হয়েছিল ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের বিমান হামলার পরিণতিতে।

বোমা হামলার প্রথম রাতে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে এবং বোমার শব্দে আতঙ্কিত মায়েরা বাগদাদের একটি হাসপাতালের ইনকিউবেটর থেকে তাদের সদ্যোজাত বাচ্চাদের নিয়ে ঠাণ্ডা বেজমেন্টে গিয়ে আশ্রয় নেয়। নিউ ইয়র্ক টাইমস জানায়, ‘ওই ঘটনায় ৪০টি সদ্যজাত শিশু মারা গিয়েছিল।’

৪২ দিনের ওই যুদ্ধে কয়েক হাজার বেসামরিক লোক মারা যায়। যার মধ্যে ছিল ৪০টি সদ্যোজাত ইরাকি শিশু।

কুয়েতে ইনকিউবেটরের শিশু মৃত্যুর কাহিনী যে মনগড়া তা প্রেসিডেন্ট বুশ জানতেন কি জানতেন না তা কখনই পরিষ্কার হয়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট যখন কোনো বক্তব্য দেন হোয়াইট হাউজ আগে থেকে তার সত্যতা যাচাই করে বা তাদের তা করার কথা। বিশেষ করে শিশু হত্যার মত স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে প্রেসিডেন্ট কোনো কথা বলার আগে তা যাচাই করা তার স্টাফদের অবশ্য কর্তব্য ছিল। তবে কংগ্রেসের সামনে কুয়েতি কিশোরী নারিয়ার ওই মনগড়া শুনানির ব্যাপারে মার্কিন সাংবাদিকরা জানতে পেরেছিলেন যুদ্ধের পর।

২০১৮ সালে বুশের মৃত্যুর পর তার যে জীবনী লেখা হয়েছে তাতেও নারিয়ার সেই গল্প নেই। কিন্তু পক্ষান্তরে ট্রাম্পের শাসনামলে তার বক্তব্য বিবৃতি ব্যাপকভাবে যাচাই করেছে মার্কিন মিডিয়া। ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় ট্রাম্পের বক্তব্য-বিবৃতির একটি ডাটাবেজ রয়েছে। পত্রিকাটি দাবি করে ট্রাম্প ৩০ হাজারেরও বেশি এমন সব বক্তব্য দিয়েছেন যা অসত্য, বিভ্রান্তিকর।

এমনকি গল্ফ খেলা বা তার নিজের সম্পত্তি নিয়ে ট্রাম্পের মন্তব্যও যাচাই করেছে পত্রিকাটি। নির্বাচন প্রক্রিয়াই ‘দানব’ সৃষ্টি করছে

আমেরিকার রাজনীতিতে মিথ্যাচার নিয়ে লেখা এক বইতে রাজনীতির অধ্যাপক বেঞ্জামিন গিনসবার্গ বলেছেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যাচারের পরিণতি হয়েছে ভয়াবহ।

তিনি বুশের ছেলে প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের (বুশ জুনিয়র) অনেক মিথ্যা বিবৃতির উল্লেখ করেন। যেগুলো দ্বিতীয় ইরাক যুদ্ধের আগে দেয়া হয়েছিল। যেমন, ইরাকি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের হাতে বিপজ্জনক মারণাস্ত্র থাকা নিয়ে গোয়েন্দাদের সন্দেহ ইচ্ছা করে চেপে রাখা, সাদ্দাম হোসেনের কাছে এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র থাকার সম্ভাবনা বার বার বলা বা সাদ্দামকে আল-কায়দার মিত্র বলে চিহ্নিত করা।

অধ্যাপক গিনসবার্গ বলেন, প্রেসিডেন্টদের অনেক মিথ্যা ভাষণের পরিণতিতে যুদ্ধ হয়েছে। সেদিক দিয়ে ট্রাম্পের চেয়ে তার পূর্বসূরিদের দায় অনেক বেশি।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতির এই শিক্ষক বলেন, ‘সমস্যা হচ্ছে যে আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়াতেই গলদ রয়েছে, যার ফলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনেক দানব সৃষ্টি হয়েছে। প্রার্থী হতে বছরের পর বছর ধরে প্রচারণা চালাতে হয়। ফলে, সবচেয়ে উদ্ধত, উচ্চাভিলাষী, আত্ম-প্রেমিক এবং দাম্ভিক ব্যক্তিরাই এই প্রক্রিয়ার অংশ হন।’

আমেরিকান জনগণ একসময় তাদের সেনাপতিকে শিশুর মত সরলভাবে বিশ্বাস করতো। মানুষের কাছে তখন প্রেসিডেন্টের অবস্থান ছিল অনেকটা ঈশ্বরের মত।

কখন তা বদলে গেল? অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, লিন্ডন বেইনস জনসনের সময় থেকে মিথ্যাচারের সূচনা। কিন্তু তিনিই যে প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি মিথ্যাচার করেছিলেন-সেটা ঠিক নয়।

জনসনের মিথ্যাচার
প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই রবার্ট কেনেডি প্রেসিডেন্ট জনসন সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তিনি সবকিছু নিয়ে সর্বক্ষণ মিথ্যা বলেন। প্রয়োজন ছাড়াই তিনি মিথ্যা বলেন।’

ভিয়েতনামের যুদ্ধের যুক্তি খাড়া করতে জনসন ১৯৬৪ সালে অক্টোবর মাসে টনকিন উপসাগরে একটি নৌ হামলার কথা বলেছিলেন। যে হামলা আসলে কখনই হয়নি। অথচ সেই বিবৃতির জন্য বিরোধের মাত্রা নাটকীয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল।

নির্বাচনের আগে জনসন ওহাইওতে এক সভায় ভোটারদের বলেছিলেন, তিনি ১০ হাজার মাইল দূরে এশিয়ার একটি দেশে আমেরিকান সৈন্য পাঠাবেননা কিন্তু জেতার পরপরই চুপিসারে তিনি সৈন্য পাঠিয়েছিলেন। যে সংখ্যা শেষ পর্যন্ত পাঁচ লাখেরও বেশি।

বিদেশনীতি নিয়ে নিয়ে প্রেসিডেন্ট জনসন এত বিভ্রান্তিমুলক কথা বলতেন যে আমেরিকান মিডিয়া তখন খোলাখুলি বলতো যে, এই প্রশাসনের কথার ওপর আস্থা রাখা যায় না।

জনসনের উত্তরসূরি রিচার্ড নিক্সন ভিয়েতনাম যুদ্ধের একটি ‘সম্মানজনক’ সমাপ্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনে লড়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় এসে কম্বোডিয়ায় কার্পেট বোমা ফেলে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলেছিলেন। এরপর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর আড়ি পাতার জেরে-যেটি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত-ক্ষমতা হারান নিক্সন।

সততার রোল মডেল
স্কুলের বইতে প্রেসিডেন্টদের সততা নিয়ে লেখা গল্প পড়িয়ে আমেরিকায় বাচ্চাদের সততা এবং মূল্যবোধ শেখানো হতো। কিন্তু বাস্তবে সেই সততার কোনো অস্তিত্ব কখনই ছিল না।

প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনকে নিয়ে বিখ্যাত এক গল্প রয়েছে যে বাগানের চেরি গাছ কুড়োল দিয়ে কেটে ফেলার পর তিনি তার বাবার কাছে দোষ স্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমি মিথ্যা বলতে পারি না বাবা। কিন্তু প্রেসিডেন্টের একজন জীবনী রচনাকারী এই গল্পটি স্রেফ বানিয়ে লিখেছিলেন।’

আমেরিকান জাতির পিতাও শতভাগ সাধু ছিলেন না। যেমন ১৯৮৮ সালে তিনি নতুন করে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা করেন যখন তিনি দাবি করেন যে, সাত বছর আগেই তিনি ইয়র্কটাউনে ব্রিটিশদের পরাজিত করার মূল পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে ভার্জিনিয়ায় সেই গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরানো যুদ্ধের প্রধান হোতা ছিল তার ফরাসী মিত্ররা। আমেরিকায় প্রেসিডেন্টদের মিথ্যাচারের শুরু হয়তো ছিল সেটাই।

আকাশকুসুম কল্পনা
হোয়াইট হাউজের বাসিন্দাদের কিছু কিছু মিথ্যাচার আকাশকুসুম কল্পনার মত। যেমন প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন সফরকারী ইউরোপীয় একজন প্রকৃতি বিজ্ঞানীকে বলেছিলেন, আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে জনমানবশূন্য এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে এখনো পশামাবৃত ম্যামথ (হাতির মত দেখতে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী) চরে বেড়ায়।

১৯৮৩ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান বলেন ইউরোপে মার্কিন বাহিনীর সিগনাল কোরের আলোকচিত্রি হিসাবে কাজ করার সময় তিনি নাৎসি বন্দী শিবিরে নির্যাতনের ছবি তুলেছেন। হোয়াইট হাউজে সে সময়কার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইতজাক শামিরের সাথে আলাপের সময় রেগান এই গল্প করেন। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি আমেরিকার বাইরে কখনই যাননি।

ওয়াশিংটনে পোস্টের তালিকায় জায়গা পাওয়া ট্রাম্পের অনেক বক্তব্যই হয়তো গুরুত্বহীন। কিন্তু একজন ইতিহাসবিদ বলেন, ট্রাম্প যেভাবে অকাতরে মিথ্যাচার করেছেন তাতে আমেরিকার রাজনীতি এবং প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ধসে পড়েছে।

রাষ্ট্রের মিথ্যাচার নিয়ে তার এক বইতে অধ্যাপক এরিক অলটারম্যান বলেছেন-আমেরিকা রাষ্ট্র সৃষ্টির শুরু থেকেই প্রেসিডেন্টদের মিথ্যাচার মানুষ সহ্য করেছে, কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প অতীতের সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছিলেন।

মিথ্যাচার নিয়ে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের নির্লজ্জতাও ছিল অবিশ্বাস্য।

১৯৯৮ সালে জানুয়ারিতে হোয়াইট হাউজের ইনটার্ন মনিকা লিউনিস্কির সাথে তার যৌন সম্পর্কের অভিযোগ জোরগলায় অস্বীকার করেছিলেন তিনি। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে অস্বীকার করেছিলেন। পরে এক তদন্তের তার মিথ্যাচার ফাঁস হয়ে যায়। কিন্তু জাতিকে ধোঁকা দেয়া নিয়ে লজ্জা পাওয়ার বদলে শাস্তি না হওয়ার জন্য ক্লিনটন আড়ালে স্বস্তি প্রকাশ করেছিলেন বলে তার জীবনীমুলক একটি গ্রন্থে (দি সারভাইভর) প্রকাশিত হয়েছে।

১৯৯৮ সালের অগাস্টে এ নিয়ে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারের আগে তিনি এক বন্ধুকে বলেছিলেন, ‘মিথ্যা আমাকে বাঁচিয়েছে।’

অথচ হোয়াইট হাউজের যে ঘরে রাষ্ট্রীয় ভোজসভা হয় সেখানে খোদাই করে লেখা রয়েছে-এই ছাদের নীচে শুধু যেন সৎ এবং জ্ঞানী ব্যক্তিরাই শাসক হিসেবে আসেন।

সূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন ::

Back to top button