জানা-অজানা

ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গেলে কী করবেন

ঘুরতে গিয়ে হারিয়ে গেলে কী করবেন

শহুরে মানুষদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ঘুরতে যাওয়া আজকাল একটা অভ্যাস হয়ে গেছে যেন! কয়েকদিনের ছুটি পেলেই বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকাগুলোতে যেতে দেখা যায় হাজার হাজার মানুষ। বন-জঙ্গল এর উপরে এই আকর্ষণ খারাপ নয়, তবে বেশিরভাগ সময়ই তা সেই এলাকার উপরে খারাপ প্রভাব ফেলে।

সে যাই হোক, আজ আমরা পরিবেশের উপরে পর্যটকদের প্রভাব নিয়ে কথা বলতে আসি নি, আজ আমরা কথা বলব বনে-জঙ্গলে ভ্রমণকালে হারিয়ে গেলে কী কী করার আছে আপনার।

ট্রেকিং এবং হাইকিং দিনে দিনে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হচ্ছে। তরুণরা নিয়মিতভাবে এইদিকে ঝুঁকে পড়ছে। দলবেঁধে পাহাড়ি এলাকায় যাওয়া আজকাল নিয়মিত ঘটনা। আপনি যখন পাহাড়ি পথে যাচ্ছেন দলবেঁধে, কেউ এগিয়ে যাবে, কেউ পিছিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। সবার শারীরিক সক্ষমতা এক রকম নয়। হতে পারে আপনিই সেই মানুষটা, যে পিছিয়ে পড়বেন এবং এক সময় দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন।

হতে পারে আপনিই সেই মানুষটা যে ফুল-প্রজাপতির ম্যাক্রো ফটোগ্রাফি নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বুঝতেই পারেনি কখন তার দল তাকে রেখে এগিয়ে গিয়েছে। অথবা আপনি সেই মানুষটা, যিনি দল থেকে বেশি এগিয়ে গিয়ে ভুল রাস্তায় চলে গেছেন, আপনি ডানে তো আপনার দল বামে।

এসব ক্ষেত্রে সবসময়ই মনে রাখা ভাল যে প্রিভেনশন ইজ বেটার দেন কেয়ার। হারিয়ে যেতে পারেন, এরকম চিন্তা ভাবনা করে সেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখাটাই সবচেয়ে সেরা উপায়, সাথে একটি হুইসল রাখুন, ইমারজেন্সী কিট রাখুন, ছোটখাটো টর্চ-লাইট তো রাখা যেতেই পারে। এগুলোর জন্য যে বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে, তা কিন্তু না। আপনি ভ্রমণে গেলে এগুলো সাথে এমনিতেই রাখাটা জরুরী। আর দলনেতারও উচিত সবাইকে বুঝিয়ে দেয়া যে হারিয়ে গেলে কি করতে হবে বা সে আপনার কাছ থেকে কি আশা করছে।

আপনি দল বেঁধে কোথাও গেলে সাথে সাধারণত গাইড থাকবে একজন অথবা এক দুইজন অভিজ্ঞ মানুষ যারা এই পথে আগে চলেছেন। তাদের সাথে আলোচনা করে এলাকার কোথায় কি আছে, আপনাদের আগামী পথে কি আশা করতে পারেন, সেগুলো জেনে নিন। যেখানে যাচ্ছেন, সেই এলাকার একটি সাধারণ দিক নির্দেশনার ধারণা করে নিন। যখন ট্রেইলে থাকবেন, তখন আপনি কোথায় আছেন সেটা নিয়ে খেয়াল রাখুন। আপনার দল কোথায় আছে সেটাও খেয়ালে রাখুন।

মাঝে মাঝেই গাইডের সাথে বা অভিজ্ঞ কারও সাথে কথা বলে নিজের অবস্থান এবং সামনে কি আছে সেটা নিয়ে নিজের জানাশোনা আপডেট করে নিন এবং সর্বশেষ, চোখ কান খোলা রাখুন সবসময়ই।

এতকিছুর পরেও আপনি যদি হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেন যে আপনি একা দাঁড়িয়ে, আপনার বাদবাকি লোকজন কোথায় সেটা আপনি জানেন না, তাহলে করনীয় আছে বেশ কিছুই। উপরের সবকিছু যদি আপনি করে থাকেন, তাহলে আপনার ধারণা তৈরি হয়েছে আপনাদের দলগত গন্তব্য সেদিন কোথায়। আপনার দল কোথায় গিয়ে রাতে আস্তানা পাতবেন। আপনি নিজের অবস্থান বুঝে নিন, ডানে বামে কোন দিকে পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ সেটা বুঝে নিন এবং হুইসল বাজাতে শুরু করুন।

খানিকটা বিরতি দিয়ে বাজিয়ে যান বেশ কিছুটা সময় এবং অপেক্ষা করতে থাকুন। আপনার দলের অভিজ্ঞ কেউ, অথবা গাইড নিজেও যদি সেই হুইসল শুনতে পায়, আপনাকে উদ্ধার করতে ফিরে আসবে নিশ্চয়ই। ফোন করার সুযোগ না থাকারই কথা, নেটওয়ার্ক পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। পেলে তো ঝামেলা শেষ। কিন্তু না পেলে হুইসল।

এখন যদি দেখা যায়, ঘণ্টা-খানেক পার হয়ে গেছে, কেউ আসছে না, তাহলে সম্ভাবনা হল তারা আপনার হুইসল শোনার আগেই বেশ অনেকটা দূর চলে গেছে। এখন আপনার হাতে উপায় দুটো।

এক: আপনি অপেক্ষা করতে পারেন। তারা একটা সময় বুঝতে পারবে যে তাদের সাথে কেউ একজন নেই। কে নেই সেটাও খুব দ্রুতই বের হয়ে আসবে। তারা ধরে নেবে আপনি পথে কোথাও থেমে গেছেন, তাদের সাথে যোগ দিতে পারেন নি। তারা খুব করে আশা করবে যে আপনি যেখানে আটকে গেছেন সেখানেই থেকে যাবেন বুদ্ধিমানের মত, কারণ ডানে বামে চলে গেলে আপনাকে খুঁজে পাওয়া হয়ে যাবে অসম্ভব কঠিন একটা কাজ। অন্যদিকে আপনি যেখানে আটকে গেছেন, সেখানেই থেকে গেলে আগে হোক, পরে হোক তারা সেই পথে ফেরত আসবে এবং আপনাকে পেয়ে যাবে। সুতরাং এই বুদ্ধিতে, আপনার জন্য সেরা উপায় হল, যেখানে হারিয়ে গেছেন বলে মনে হয়, সেখানেই থেকে যান। অপেক্ষা করুন, চোখ কান খোলা রাখুন, যারা আসবে তারা নাম ধরে ডাকাডাকি করবে অথবা হুইসল বাজাবে।

আপনি না শুনলে তাদেরকে মিস করতে পারেন। যখন অপেক্ষা করবেন, পানি হিসেব করে খান। শুকনো খাবার সাথে থাকলে ভাল, না থাকলেও সেরকম চিন্তার কিছু নেই। দু এক দিন না খেলেও মারা যাবেন না, তবে পানিটা এক দিন না খেলে বাজে অবস্থা হবে। আপনি যদি আশে পাশে ছায়া বা আরামদায়ক জায়গায় গিয়ে বিশ্রাম নিতে চান, তাহলে অবশ্যই পথ বা যেখানে নিেজকে আবিস্কার করেছেন, সেখানে এমন কিছু রাখুন যেন বোঝা যায় সেখানে কেউ ছিল। উজ্বল রং এর জামাকাপড় মাটিতে বিছিয়ে পাথর বা ভারী কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে রাখতে পারেন বা গাছের ডালে ঝুলিয়ে দিতে পারেন পতাকার মত করে।

আবার অপেক্ষা করতে করতে আপনি দূরের মানুষদের সিগনাল দেবার জন্য আগুন জ্বালিয়ে কালো ধোয়া তৈরির চেষ্টা করতে পারেন। সাথে ম্যাচ বা লাইটার থাকলে সেটা সহজেই করা সম্ভব। তবে বিশেষ সতর্ক থাকতে হবে যে আপনার মাধ্যমে আবার দাবানল না তৈরি হয়, সেটা কারও জন্যই ভাল হবে না। আগুন জ্বালানো সোজা নয়, বিশেষ করে যখন আপনি মানসিক চাপের মাঝে আছেন। আগুন জ্বালাতে পারলে তার উপরে কাচা লতা পাতা দিলে কালো ধোঁয়া হবে। সেটা দেখে আপনার দলের লোক কিংবা স্থানীয় কেউ চলে আসতেও পারে আপনার কাছে।

দুই: আপনি যদি আত্মবিশ্বাসী হন যে সামনের পথ আপনার চেনা বা আপনি চিনে যেতে পারবেন বা সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তাহলে এগিয়ে যাওয়াটাই ভাল হবে। হতে পারে এমন একটা জায়গায় আপনি গিয়ে থামলেন যেটার কথা আপনি আগে শুনেছেন, যেটাকে পার করে দলের এগিয়ে যাবার কথা। হতে পারে কোন আদিবাসী মাচান, জুমঘর কিংবা কোন ঝর্ণা। আপনি সেখানেও তাদের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন। কারণ একবার ভুল পথে চলে গেলে আপনার সুস্থ ভাবে ফিরে আসাটার সম্ভাবনা অনেকখানি কমে যাবে।

আবার আপনি ফিরে যেতে পারেন আপনাদের যাত্রা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল। কাজটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে কয়েক দিক থেকেই। পাহাড়ে হাঁটতে গেলে মানুষের দিক নিয়ে ধারণা নষ্ট হয়ে যায় প্রায়ই। আর চারিদিকে গাছ, ঝোপ-ঝাড় সব মিলিয়ে খুব কড়া সম্ভাবনা আছে আপনি রাস্তা হারিয়ে অন্য কোন দিকে চলে যাবেন। আবার আপনি যদি যাত্রা শুরুর জায়গায় ফিরে যেতেও পারেন, আপনি হয়ত নিরাপদ হবেন, কিন্তু আপনার দল আপনাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবে, তাদের ট্যুর মাটি।

সুতরাং সব দিক বিবেচনা করলে বোঝাই যায় যে হারিয়ে গেলে যেখানে আছেন, সেখানেই কোন নিরাপদ জায়গা বেছে নিয়ে চোখ কান খুলে অপেক্ষা করাটাই সেরা উপায়। ভাগ্য ভাল থাকলে আপনি স্থানীয় কারও দেখা পেয়ে যেতে পারেন, তার সাথে কথা বলে নিজের অবস্থান জেনে নিয়ে তারপর বিবেচনা করে দেখতে পারেন কি করবেন। তবে যে কোন বিচারেই, অপেক্ষা করাটাই সেরা উপায়।

যে কোন ঝামেলায় না পড়ার সেরা উপায় হল আগে থেকেই সতর্ক থাকা, চোখ কান খোলা রাখা। তবে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। তাই হলে কি হবে সে বিষয়েও জ্ঞান থাকাটা জরুরী।

আরও পড়ুন ::

Back to top button