Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
জানা-অজানা

বাংলার বধূর সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে করুণ ইতিহাস

বাংলার বধূর সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে করুণ ইতিহাস
ছবি নারী সিরিয়াল কিলারকে নিয়ে করা একটি সিনেমার দৃশ্য

সিরিয়াল কিলারের কথা শুনলেই প্রথমেই সবার মাথায় আসে জ্যাক দি রিপারের কথা। যে কিনা তৎকালীন সময়ে লন্ডনের হোয়াইট চ্যাপেলের এক আতংকের নাম। বেছে বেছে যৌনকর্মীদের খুন করতেন তিনি। খুবই নৃশংস ছিল তার হত্যার ধরণ। কে ছিল সেই জ্যাক দ্য রিপার, তা আজো ধোঁয়াশা।

যদিও সন্দেহের বশে পুলিশ অনেককেই জ্যাক দ্য রিপারের তকমা দিয়েছে। বিনা দোষে হয়তো অনেকে শাস্তিও পেয়েছে। তবে সে যাই হোক, পরবর্তিতে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এমন অনেক সিরিয়াল কিলারের নাম পাওয়া গেছে। কেউ কেউ ছিলেন মানসিক রোগী। কারো বা ছিল নেশা। মানে ঝোকের বশে নাকি খুন করতেন তারা। সিরিয়াল কিলারের তালিকায় রয়েছে অনেকের নাম। তবে আজ বলছি এক নারী সিরিয়াল কিলারের কথা।

নারী শুনে অবাক হচ্ছেন নিশ্চয়! হবে আরো জেনে অবাক হবেন যে, এই নারী ছিলেন বাঙালি এবং ভারতবর্ষের এক সাধারণ গৃহবধূ। আরো একটু খোলাসা করে বললে, এই কলকাতা শহরের বুকেও ছিল এমনই এক নৃশংস সিরিয়াল কিলার। না স্টোনম্যান নয়, বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে উঠে আসে এক বাঙালি নারীর নাম। কেন সাধারণ এক গৃহবধূ সিরিয়াল কিলার বনে গিয়েছিলেন? কেমন ছিল তার জীবন? সব প্রশ্নের উত্তর জানবো আজ।

বর্ধমানের এক প্রত্যন্ত গ্রাম। আর দশটা গ্রামের মতোই এখানকার চিত্র। ঘরের নারী সদস্যরা ব্যস্ত ঘর সংসার আর সন্তান লালন পালনে। আর বাড়ির পুরুষেরা বেশিরভাগই ব্যস্ত থাকেন চাষের কাজে। এশিয়া তথা বাংলার খুবই নিতান্ত নিস্তরঙ্গ জীবনের চিত্র এটি। এই গ্রামেই বসবাস করত ত্রৈলোক্যতারিণী। অন্যদের মতো তারিণীর বাবাও সাধারণ ভাগচাষি। সংস্কারের আলো তখনও সেভাবে ছুঁতে পারেনি হিন্দু সমাজকে।

আরও পড়ুন : ভোগবিলাসে মত্ত রানির কারণেই ফ্রান্স হয় ফকির, ঘটে ‘ফরাসি বিপ্লব’

স্বাভাবিকভাবেই সমাজে পুরোদমে চলছে বাল্যবিবাহ। কৈশোরের কোঠা পেরুবার আগেই বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। তবে অন্যদের মতো স্বামীর ঘর কিংবা সন্তানের মুখ দেখে নি তারিণী। তার বিয়ে ছিল নাম-কা-ওয়াস্তে। সতীনের জন্য কোনোদিন শ্বশুরবাড়ির মুখ দেখার সুযোগ হয়নি তারিণীর। ফলে সময়ের নিয়মে একসময় শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ কমতে কমতে সম্পর্কের পাঠও চুকে যায় একসময়।

তবে সবে যৌবনে পা রাখা মেয়েটি জড়িয়ে যায় নতুন এক সম্পর্কে। গ্রামের এক যুবকের সঙ্গে রাতের অন্ধকারে হঠাৎ করেই গ্রাম থেকে পালিয়ে যায় তারিণী। এরপরই তারিণীর ভোলবদল। বিয়ের পরেও প্রেমের সম্পর্ক, গ্রামে কানাকানির সূত্রপাত ঘটেছিল আগেই। এতে করে তারিণীর জন্য তার বাপের বাড়ির দরজাও চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে গেল।

বাংলার বধূর সিরিয়াল কিলার হয়ে ওঠার পেছনে করুণ ইতিহাস
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দারোগার দপ্তর বই থেকে জানা যায় তারিণীর সম্পর্কে

তাতে কি? যার হাত ধরে পালিয়েছে যে তো ভালোবাসে তাকে। সুখে রাখার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। তবে তারিণী তার মর্যাদা দিতে ছিল অপারগ। দুজনে কলকাতার সোনাগাছি অঞ্চলে ভাড়া থাকতে শুরু করে তারা। বেশ ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের। তবে তারিণী সেই যুবকের সঙ্গে থাকতে চায় না। নিজের মতো করে জীবনযাপন করার ইচ্ছা তার। সোনাগাছিতে থাকতে শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তারিণীর প্রথম প্রেমিকের। এই ঘটনায় সন্দেহের তীর যায় তারিণীর দিকেই।

আরও পড়ুন : ভ্যাম্পায়ারের দাঁত যেভাবে সূঁচালো হলো

এর মধ্যেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করে পতিতাবৃত্তি। আর এই পতিতাবৃত্তির সূত্রেই তার পরিচয় ঘটল অপরাধ জগতের মাথাদের সঙ্গে তারিণীরে পদার্পণ ঘটল অপরাধ জগতের বৃত্তে। পুলিশও শুরু করল তদন্ত। কিছুদিনের মধ্যেই আটক করা হয় তারিণীকে। কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় সে। সেই শুরু। তারপর দিন যত এগিয়েছে, ততই লম্বা হয়েছে খুনের লিস্ট। এরই মধ্যে একের পর এক পুরুষ এসেছে তারিণীর জীবনে।

দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা দারোগার দপ্তর থেকে জানা যায় তারিণীর এই জীবন সম্পর্কে। অবশ্য পুলিশের পাশাপাশি সেই সময়ের একজন স্বনামধন্য লেখক হিসেবে পরিচিতি ছিল প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের। ১৮৭৮-১৯১১ সাল পর্যন্ত তিনি কর্মরত ছিলেন পুলিশ বিভাগে। তার প্রকাশিত বই ‘দারোগার দপ্তর’ থেকেই আরো বিস্তারিত জানা যায় বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার সম্পর্কে। তবে শুধুমাত্র ‘দারোগার দপ্তরে’-ই সীমাবদ্ধ থাকেনি তারিণীর কুকীর্তি। পরবর্তীকালে দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের ‘বাবু ও বারবনিতা’ বইটিতে বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে তারিণীর নাম।

এই বইগুলো থেকেই জানা যায় সেইসব পুরুষ সঙ্গীদের সাহায্যেই ধনী বাড়ির মেয়েদের শিকারে পরিণত করত তারিণী। কিছুদিনের মধ্যেই প্রায় পাঁচটি খুন করে ফেলে সে। মাত্র কিছুদিনের ব্যবধানে উধাও হয়ে গেলেন পাঁচজন নারী। সবাই বেশ ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যা ছিলেন। এরপরেই টনক নড়ে পুলিশের। শুরু হল তদন্ত। তদন্তের শুরুতেই অদ্ভুত এক তথ্য উঠে এল পুলিশের হাতে। তারা জানতে পারল, পাঁচটি মৃত্যুর প্রত্যেকটি হয়েছে মানিকতলা এলাকায় এমনকি পাঁচটি মৃত্যুর প্রতিটির ধরন একই।

প্রত্যেকের মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে। কিছুদিনের চেষ্টায় পুলিশের জালে ধরা পড়ল তারিণী। পুলিশি তদন্ত শেষে উঠে আসে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। শুধুমাত্র গয়নার লোভে একের পর এক খুন করে গেছে ত্রৈলোক্যতারিণী। এই ব্যাপারে তার মূল ঘাঁটি ছিল মানিকতলা এলাকার একটি পরিত্যক্ত বাগানবাড়ি। এখানেই বিভিন্ন ছলনায় তার শিকারদের ডেকে এনে গয়না লুঠ করে তারপর তাদের জলে ডুবিয়ে হত্যা করত তারিণী।

আরও পড়ুন : মেয়েরা চুড়ি ও নাকফুল না পরলে স্বামীর আয়ু কমে!

আর সেই কাজটি করার সময়ই একজন দেখে ফেলে তাকে। তারিণীকে গ্রেপ্তারের পিছনে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। জেরার পর তারিণী স্বীকার করেছিল, পেট চালাবার জন্য একপ্রকার বাধ্য হয়ে তাকে এই উপায় অবলম্বন করতে হয়। এর আগেও বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন চুরি এবং প্রেমিকের হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়েছিল সে। কিন্তু প্রতিবারই প্রমাণ অথবা সাক্ষীর অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কিন্তু এবার পুলিশের হাতে ছিল অকাট্য প্রমাণ।

এসব ঘটনায় প্রথমবার তাকে গ্রেফতার করা হলে প্রিয়নাথ মুক্তি দেন ত্রৈলোক্যতারিণীকে। এটি ছিল প্রিয়নাথের একটি ফাঁদ। এরপর পুলিশ গ্রেফতার করেন ত্রৈলোক্যতারিণীর পালিত ছেলে হরিকে। রাজসাক্ষী করেন ত্রৈলোক্যতারিণীর সঙ্গী ষড়যন্ত্রীকে। এমন ভাবে ঘটনাক্রম সাজান, যাতে মনে হয় হরি-ই খুনি। সবাই এমন ভাবে সাক্ষ্য দেন, যেন হরি যে ঘটনায় জড়িত তা নিয়ে তারা নিশ্চিত।

শেষে প্রিয়নাথের সাজানো ফাঁদে ধরা দিতে বাধ্য হয় ত্রৈলোক্যতারিণী। ছেলেকে বাঁচাতে অপরাধ স্বীকার করে সে। নিজের ঘরের লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেয় খুনের পরে নিহত তরুণীর লুঠ করা গয়না। সব অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় তারিণীকে সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়।

আরও পড়ুন : বেয়ার গ্রিলসের জীবনের অজানা ১০ তথ্য

আরো একটি তথ্য জানিয়ে রাখি আপনাদের। জ্যাক দি রিপারের ঘটনার প্রায় বছর আটেক আগেই কলকাতার বুকে ঘটে যায় এই নৃশংস সিরিয়াল কিলিং। যদিও কলকাতার অন্য এক সিরিয়াল কিলার স্টোনম্যানের মতো অমীমাংসিত থাকেনি তারিণী-রহস্য। তবে শুধুমাত্র গয়নার লোভের জন্য সিরিয়াল কিলিং হয়তো অপরাধ বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই প্রথম।

কিন্তু তলিয়ে দেখলে হয়তো অন্য সত্যই সামনে উঠে আসে। বাল্যবিবাহ, শ্বশুরবাড়ির অবেহেলায় কি আড়াল থেকে পশ্রয় দিয়েছিল তারিণীকে? তার অজান্তেই তার অবচেতন মনে হয়তো রেখাপাত করে গিয়েছিল একের পর এক লাঞ্ছনার ঘটনা, যা তাকে পরবর্তীকালে করে তুলেছে বাংলার অন্যতম নৃশংস সিরিয়াল কিলার!

তবে এখানেও প্রশ্ন ওঠে, একজন নারী হিসেবে তাকে তৎকালীন সময়ের সব অবমাননা সহ্য করতে হয়েছে মুখ বুজে। কিন্তু তার পরেও খুনের জন্য নারীদেরই কেন টার্গেট করল তারিণী? নাকি নারীরাই ছিল তার কাছে সহজ উপায়। অপরাধ বিজ্ঞানে বারংবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে জ্যাক দি রিপার থেকে জিল দ্য রাই। আর এসবের মধ্যেই আড়ালেই থেকে গেছে বাংলার প্রথম সিরিয়াল কিলার তারিণী। তবে এই নারীর পূর্ববর্তী জীবন কাওকে হয়তো ভাবায়নি। তাইতো ইতিহাসে তার ঠাই হয়েছে শুধু সিরিয়াল কিলার হিসেবেই।

আরও পড়ুন ::

Back to top button