গল্প

উপলব্ধি ::: পুষ্পিতা ভৌমিক

পুষ্পিতা ভৌমিক

উপলব্ধি ::: পুষ্পিতা ভৌমিক - West Bengal News 24

__”কিগো শুনছো? এক সপ্তাহ পরে আমাদের টুকুনের গরমের ছুটি পড়ছে। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়ে ওঠেনি। একসাথে কোথা থেকে ঘুরে এলে হয়না? তুমি কি বলো?”;ছেলে টুকুনকে রাতের খাবার খাওয়াতে খাওয়াতে স্বামী রঞ্জনের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে মহুয়া। এদিকে যাকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলা সেই রঞ্জনের মন তখন নন্দিনীর চিন্তায় মগ্ন। নন্দিনী মানে তমালের বোন। কলকাতায় পূর্তদপ্তরের অফিসে চাকরি করত রঞ্জন আর তমাল। কিন্তু হঠাৎ একটা পথ দুর্ঘটনায় তমাল মারা গেলে ওর চাকরিটা পায় ওর ছোট বোন নন্দিনী। রঞ্জনের কাছে নন্দিনী একঝলক মিঠে বাতাসের মত। আগে বহুবার তমালের সাথে বন্ধুত্বের সূত্র ধরে ওদের বাড়ি যাবার সুবাদে নন্দিনীর সাথে একটা সহজ সরল সম্পর্ক ছিল রঞ্জনের তবে সাত বছর ধরে প্রতিদিনকার একঘেয়ে সাংসারিক জীবনে বোধয় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছিল রঞ্জন। বছর দুই আগে তমালের মারা যাওয়াটা অনুঘটকের কাজ করল দুজনের জীবনে। অফিসে বিভিন্ন কাজ বুঝিয়ে দেবার সূত্র ধরে ক্রমশ নন্দিনীর কাছাকাছি পৌঁছে গেল রঞ্জন।

বিয়ের পর সাত বছর ধরে স্ত্রী মহুয়ার সেই এক রোজনামচা, দায় দায়িত্বপালন, একই শারীরবৃত্তীয় পথ ধরে কুচকাওয়াজ করতে করতে একঘেয়েমি ধরে গেছে রঞ্জনের। প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার পথে বাজারের থলি হাতে বাজার করা, ছেলে টুকুনের জন্যে কখনো হেলথ ড্রিংক কখনো স্কুল প্রজেক্টের জিনিস কেনার থেকে এখন রঞ্জনের অনেক বেশি ভালোলাগে নন্দিনীর সাথে সময় কাটাতে। কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে মায়াবী আলোয় ফ্রেশ লাইম সোডা খেতে খেতে ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে। নন্দিনীর মোহময়ী দৃষ্টিতে সম্মোহনের চোরাবালিতে সবসময় ডুবে থাকতে ইচ্ছা করে রঞ্জনের। এদিকে রঞ্জন বিবাহিত জেনেও নন্দিনী ওর দাদা তমাল মারা যাবার পর অফিসের নানা কাজ বোঝার অছিলায় বিশেষ করে বলা ভাল কোনো এক অদৃশ্য অমোঘটানে এগিয়ে আসে রঞ্জনের দিকে। ওদের বাড়িতেও রঞ্জনকে ভরসা করে ওর মা বাবা বলেন, “তুমি আছ বলেই নন্দিনীর একটা ভরসা”। মাঝেমধ্যে পাপবোধ থেকে নন্দিনী সরে যেতে চাইলেও রঞ্জন ওর গালে ঠুনকো মেরে বলে,”ইউ আর মাই কিউটি পাই রাজনন্দিনী (আদর করে ওকে এই নামে ডাকে রঞ্জন);ছাড় ওসব পাপবোধ। বাড়িতে টাকা পয়সা দিচ্ছি। মহুয়া আর টুকুনের প্রতি আমার দায়িত্ত্ব পালন করছি এই ওদের পরম সৌভাগ্য।” যে মহুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে এককালে ওকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রঞ্জন সেই মহুয়া আজ ওর কাছে শুধু একটা দায়িত্ববোধ ওর প্রতি কোনো টান নেই আছে শুধু সাংসারিক দায়িত্ত্ব। এদিকে নন্দিনীর সৌর্ন্দয্য বসন্তকালে চোখ ঝলসে দেওয়া কৃষ্ণচূড়ার মত অতি চৌম্বকীয় শক্তিতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে যায়।

এইসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গায়ে একটা ধাক্কা মহুয়া বলে,”কিগো কোন স্বপ্নজগতে বিচরণ করছ শুনি? এতক্ষণ ধরে যে এত কথা বলছি তার কোন উত্তর নেই যে।” রঞ্জন নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দেয়,”হ্যাঁ ওই আর কী অফিসের একটু টেনশন বলো কি বলবে?”

মৃদু হেসে মহুয়া বলে, “হ্যাঁ যা বলছিলাম টুকুন বায়না করছে ঘুরতে যাবে কোথাও গরমের ছুটিতে। এই মাসের দ্বিতীয় শনিবার তো তোমার ছুটি থাকে সেই সাথে রবিবার মিলিয়ে যদি কোথা থেকে ঘুরে আসা যেত”।

অগত্যা রঞ্জন জিজ্ঞাসা করে,”কোথায় যাবে বলো তোমরা? একসাথে গাড়িতে চড়ে ঘুরে আসব তিনজন।” মহুয়া বলে,”হুম চলো তাহলে এবার বাংরিপোসি থেকে ঘুরে আসি। চারদিকে পাহাড় জঙ্গল আর সামনেই পূর্ণিমা। আমার দাদা বৌদি মানে টুকুনের মামা আর মামী মাস দুই আগে ঘুরতে গেছিল ওদের মুখে শুনলাম পূর্ণিমার আলোয় বাংরিপোসির সৌন্দর্য অপূর্ব লাগে। আমি সব বুকিং টুকিং সেরে রেখেছি ওখানকার বনবাংলোতে। এখন তুমি যদি না যাও তাহলে ক্যান্সেল করে দিতে হবে !”

অগত্যা মহুয়ার কথায় রাজি হতে হয় রঞ্জনকে।কিন্তু বাংরিপোসি নামটা শুনে বুকের মধ্যে কেমন একটা করে ওঠে। যাইহোক নির্দিষ্ট দিনে বেরিয়ে পড়ে ওরা তিনজন মিলে। রঞ্জন গাড়ি ড্রাইভ করছে। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষে কোষে তখন টাটকা বাংরিপোসির মাস তিনেক আগের স্মৃতি। ও আর নন্দিনী মিলে তো ওখান থেকে ঘুরে এলো অফিস ট্যুরের নাম করে। তার আগেও দুবার গেছে ওখানে। বনবিভাগের বাংলোতে গিয়ে উঠেছিল দুজনে। নন্দিনীর জায়গাটা খুব পছন্দ। শান্ত, নির্জন পরিবেশে নন্দিনীর মত সুন্দরী মেয়ের সানিধ্য পাওয়া যে কোন পুরুষের ভাগ্যের ব্যাপার। অফিসের অনেকেই রঞ্জনকে এই ব্যাপারে ঈর্ষা করে আর রঞ্জন পুরো ব্যাপারটা উপভোগ করে তাড়িয়ে তাড়িয়ে। হোটেলের ঘরে দুগ্ধ ফেননিভ বিছানায় নন্দিনীর শরীরের প্রতিটা ভাঁজে রঞ্জন ওর অস্তিত্ব, অধিকার মিশিয়ে দিয়েছিল প্রতিবার। নিশ্বাস ক্রমশ তপ্ত হচ্ছিল, দুজনের শিরায় শিরায় একটা স্রোত উদ্দাম চলাফেরা করছিল। বুনো হাঁসহাঁসির মত আদিম রিপুর খেলাতে মত্ত হয়ে উঠেছিল দুজনে। গাড়ি চালাতে চালাতে এসব দৃশ্য ঘোরাফেরা করছিল রঞ্জনের চোখের সামনে। ব্যাকসিটে বসে টুকুনের সাথে বকবক করছে মহুয়া।টুকুন মাঝেমধ্যে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে ওর বাবাকে প্রশ্ন করছে এটা ওটা। নিজেকে যথাসম্ভব আটকে রেখে উত্তর দিচ্ছে রঞ্জন। অবশেষে ওরা পৌঁছায় বাংরিপোসি। টুকুন আর মহুয়া ঘুরতে আসার আনন্দে মশগুল থাকলেও রঞ্জন ভিতরে ভিতরে একটা অজানা দোলাচলে ভুগতে থাকে। বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে যাবার জন্য মহুয়া অনেক করে বলেছিল বটে কিন্তু ওকে এড়িয়ে গিয়ে রঞ্জন বলেছিল এতটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসে আর ভালোলাগছেনা। মহুয়া অদ্ভুত শান্তভাবে টুকুনকে নিয়ে বেরিয়ে গেছিল।

সন্ধ্যে হতেই বারান্দায় পানীয় নিয়ে বসে রঞ্জন।টুকুন আর ওর মা তখনো ফেরেনি। যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। কিন্তু ওরা দুজন গেছিল ফিরল তিনজন মিলে। আরেকজন কে ওদের সঙ্গে? নেশাতে বুঁদ হয়ে থাকলেও ব্যাপারটা চোখ এড়ায় না রঞ্জনের। কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই টুকুন ঘুমিয়ে পড়ছে বলে ওকে খাওয়াতে নিয়ে যায় মহুয়া। ওকে খাইয়ে বিছানায় ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মহুয়া যখন স্নান সারবে বলে বাথরুমে ঢুকেছে তখন বারান্দা থেকে ঘরে ঢোকে রঞ্জন না এবার মহুয়া বেরোলে জিজ্ঞাসা করতে হবে ওকে কে এই তৃতীয় ব্যাক্তি কিন্তু বাথরুম থেকে যে বেরোল সে কে? যে মহুয়াকে এতদিন ধরে চেনে এত সে নয়। গোলাপী ফ্রিল্ দেওয়া লেসের নাইটি আর সুগন্ধির টানে আবার নতুন করে মহুয়ার নেশায় ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে রঞ্জনের। ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় রঞ্জন। কিন্তু এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নিয়ে মহুয়া বলে “কি রঞ্জন আবার আমার প্রেমে পড়লে নাকি? তাহলে তোমার নন্দিনীর কি হবে বলো?”

মহুয়ার মুখে নন্দিনীর নাম শুনে নেশার ঘোর কেটে যায় রঞ্জনের হিসহিস করে বলে “না, এসব কি বলছ! পাগল হয়ে গেলে নাকি তুমি?”

কাটা কাটা গলায় মহুয়া বলে,”হ্যাঁ পাগল তো সেদিন হয়ে গেছিলাম যেদিন তোমার কুকীর্তির কথা প্রথম জানতে পারি দীপ্তর থেকে। বেশ কিছুদিন ধরে অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফেরা,কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে এড়িয়ে যাওয়া, নন্দিনীর ফোন আসলে বাইরে গিয়ে কথা বলা বা আমি আসলে ওর ফোন কেটে দিয়ে চমকে ওঠা এগুলো চোখে পড়ছিল। তারপর একদিন টুকুনকে নিয়ে যখন বাপের বাড়ি থেকে ফিরে পেলাম বাথরুমে দেখলাম অন্য মেয়ের চুলের ক্লিপ। বেশ বুঝতে পারছিলাম নতুন কোন নারী এসছে তোমার জীবনে। এসব তো গেল ছোটখাট প্রমাণ তারপর একদিন দীপ্ত একদিন সবটা জানাল আমাকে ফোনে। কাকতালীয় হলেও এই বাংলোতে দীপ্ত ম্যানেজার পদে কাজ করে তাই সবটা এত তাড়াতাড়ি ধরা পড়ল।আমার বাপের বাড়ির পাশে থাকে দীপ্তরা। আমাদের বিয়ের সময় ও তোমাকে দেখেছিল। তাই তুমি যখন নন্দিনীকে নিয়ে এই বাংরিপোসি এসছিলে আর স্ত্রী হিসেবে আমার জায়গায় অন্য কাউকে দেখে খুব অবাক হয়েছিল দীপ্ত।

__”তারমানে ওই দীপ্ত রাস্কেলের সাথে এতক্ষণ বুঝি জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে? ওর সোহাগের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নিচ্ছিলে?”;রাগে রঞ্জন ফেটে পড়ে। শান্ত গলায় মহুয়া বলে “চিৎকার করোনা। কোনো সম্পর্ককে নোংরা করে দেখার আগে নিজের দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। দীপ্ত একসময় আমার ভালো বন্ধু ছিল তাই আমাকে সব জানিয়েছে। হতেও পারতো সবকিছু আরো পরে জানলে অনেক দেরি হয়ে যেত। যাইহোক তোমার আর নন্দিনীর প্রিয় জায়গাতে এসেই এইজন্যে সারপ্রাইজ দিলাম। তুমি এটা জেনে রাখ তোমার সাথে একসঙ্গে থাকা আর সম্ভব নয়। আদালতের নির্দেশ সঠিক সময়ে পাবে তার জন্যে তৈরী থাকো। আজ রাতে আমি অন্য ঘরে কাটাব। দীপ্ত কাল ভোরে আমাকে কলকাতায় পৌঁছে দেবে। নিজের গানের স্কুলটা আবার শুরু করব, মাথা উঁচু করে বাঁচব আমরা মা আর ছেলেতে মিলে আমাদের পৃথিবীতে আর সেখানে তোমার কোনো জায়গা নেই”;এই বলে টুকুনকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে যায় মহুয়া।

বোবা দৃষ্টিতে বারান্দায় বেরিয়ে আসে রঞ্জন।এতদিনকার জমানো অপরাধবোধ যেন হাঁ করে গিলতে আসে ওকে। অজানা কোন রাতপাখি রাতের নিস্তব্ধতা চিরে কর্কশ গলায় ডাকতে ডাকতে এগিয়ে চলে তার গন্তব্যের দিকে।বাস্তব সত্যিটা উপলদ্ধি করে রঞ্জন নিজের খুব কাছের কোন মানুষকে প্রতিনিয়ত ঠকাতে ঠকাতে কোথাও গিয়ে নিজেকেই শেষমেশ ঠকে যেতে হয়। সঠিক সময় সঠিক জবাব দিয়ে যায় এককথায় যাকে বলে,”History repeats itself” বা “ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি”।।।

(সমাপ্ত)

আরও গল্প পড়ুন ::  কথা ও কাহিনী – কলমে পুষ্পিতা ভৌমিক

Back to top button