নদীয়া

বাংলার একমাত্র নীল দুর্গা পুজো কৃষ্ণনগরে

দীপাঞ্জন দে

বাংলার একমাত্র নীল দুর্গা পুজো কৃষ্ণনগরে - West Bengal News 24

সমগ্র বঙ্গদেশে নীল রংয়ের দুর্গা প্রতিমা একমাত্র পূজিত হন কৃষ্ণনগরের নীল দুর্গা বাড়িতে। প্রতিবছর তাই কৃষ্ণনগরের দুর্গা পুজোর অন্যতম আকর্ষণ থাকে এই নীল দুর্গা বাড়ির পুজো। ফিবছর দর্শনার্থীরা ঐতিহ্যের টানে বাংলার একমাত্র নীল দুর্গা প্রতিমা দেখতে ছুটে আসেন কৃষ্ণনগরে। আসবেন নাইবা কেন? নীল দুর্গা বাড়ির দুর্গা প্রতিমা যে প্রথাগত দুর্গা প্রতিমার মতো নয়, আর এই নীল দুর্গা নিয়ে অনেক কাহিনীও রয়েছে। এখানে দুর্গা প্রতিমার গায়ের রং অপরাজিতা ফুলের ন্যায় নীল। আর কেবলমাত্র দুর্গা পুজোর সময়ই এই নীল দুর্গা দেখার সুযোগ হয়। বাংলাদেশের বরিশাল জেলা থেকে কৃষ্ণনগরে আগত চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পারিবারিক পুজো এটি। দুর্গা যেহেতু নীল বর্ণা, সেহেতু চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বাড়ির নামও হয়ে গিয়েছে নীল দুর্গা বাড়ি। আদিতে যদিও চট্টোপাধ্যায় পরিবারের দুর্গা অতসী রূপেই পূজিত হতেন। দেবীর অপরাজিতা রূপের পশ্চাতে রয়েছে চট্টোপাধ্যায় পারিবারে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা। তবে দুটি কাহিনীই লোকমুখে প্রচলিত, যার মধ্যে একটি লৌকিক এবং আরেকটি অলৌকিক।

অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার বামরাইল গ্রামে চিন্তাহরণ চট্টোপাধ্যায় এই পুজোর সূচনা করেছিলেন বলে কথিত রয়েছে। সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না, তবে প্রায় ২৯০ বছর আগে এই পুজোর সূচনা হয়েছিল বলে চট্টোপাধ্যায় পরিবার দাবি করে। দেশভাগের সময় বামরাইল গ্রামের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের সদস্যরা কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। তারা কৃষ্ণনগরের নাজিরা পাড়ায় বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে (মতান্তরে ১৯৪৮ সাল) কৃষ্ণনগরের নাজিরা পাড়াতে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের নীল দুর্গা পুজোর শুরু হয়। চট্টোপাধ্যায় পরিবারের জীবনলাল চট্টোপাধ্যায় প্রথম কৃষ্ণনগরে এই নীল দুর্গা পুজো করেন। তবে ১৯৯৮ সাল নাগাদ চট্টোপাধ্যায় পরিবারে পুজোর নানা উপাচারকে কেন্দ্র করে শরিকি মতপার্থক্য তৈরি হয়। সেই বছর থেকে আলাদাভাবে দুই পরিবার নীল দুর্গা পুজো করেন। সেই ধারা এখনো বহমান। তবে উভয় পরিবারের দুর্গা প্রতিমার বিশেষ পার্থক্য নেই। উভয় পরিবারই একচালা ঠাকুর করেন। আর প্রতিমার পিছনে থাকে চালচিত্র। আগে নীল দুর্গার চালচিত্র হাতে আঁকা হত। কিন্তু এখনকার প্রতিমা শিল্পীরা চালচিত্র প্রিন্ট করে প্রতিমার চালি সাজাচ্ছেন, যা অত্যন্ত নিরাশাজনক।

বাংলার একমাত্র নীল দুর্গা পুজো কৃষ্ণনগরে - West Bengal News 24

নীল দুর্গা বাড়ির দুর্গা প্রতিমার গায়ের রং নীল বর্ণ হল কী করে? এবার সে প্রসঙ্গে আসা যাক। এ বিষয়ে যে কাহিনীটি প্রচলিত আছে, সেটি হল— প্রতিটি বনেদি বাড়ির মতো বামরাইলের চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ঠাকুরদালানে দুর্গাপুজোর কয়েক মাস আগে থাকতে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়ে যেত। সেরকমই কোনো এক বছর তাদের পুজোর প্রতিমাশিল্পী মায়ের মূর্তি গড়া শুরু করেছিলেন। বয়সের ভার এবং পুজোর আগমনে বেশিদিন না থাকায় বৃদ্ধ প্রতিমাশিল্পী সেবার একটানা কয়েক রাত জেগে প্রতিমা গড়ার কাজ করছিলেন। প্রবীণ সেই মৃৎশিল্পী এতে অনেকটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এদিকে কয়েকদিন পরেই ছিল দেবীর বোধন। সেই সময় একদিন তিনি রাত জেগে প্রতিমার রং করছিলেন। সেই রাতেই প্রতিমার গায়ের রং শেষ করতে হত, তা না হলে কম সময়ে রং শুকাবে না এবং অন্য রঙে হাতও দেওয়া যাবে না। একে তো শরীরে ক্লান্তি তার উপর হ্যারিকেনের (মতান্তরে লম্ফ) তেল ফুরিয়ে এসেছিল। আলো প্রায় নিভু নিভু। সেই অবস্থাতেই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী প্রতিমার রং করতে থাকেন। এক হাতে হ্যারিকেন নিয়ে সেই রাতেই তিনি প্রতিমার রং শেষ করেন। হ্যারিকেনের আলোও নিভে যায়। কিন্তু ভোরের আলো প্রতিমার গায়ে পড়তেই বৃদ্ধ মৃৎশিল্পী চমকে ওঠেন। তিনি দেখেন প্রতিমার গায়ের রং ভুলবশত নীল হয়ে গেছে। নতুন রং করারও আর সময় নেই। খবরটি চাউর হতেই চট্টোপাধ্যায়দের ঠাকুরদালানে আশপাশ থেকে অনেক মানুষ এসে উপস্থিত হন। ভাবনাচিন্তা শুরু হয়— কীভাবে এই ভুল সংশোধন করা যায়। এরই মধ্যে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কর্তা চিন্তাহরণ চট্টোপাধ্যায় ঠাকুরদালানে এসে উপস্থিত হন। তিনি সকলকে জানান, সেই রাত্রে দেবী তাঁর স্বপ্নে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং আদেশ দিয়েছেন দেবীকে নীল অপরাজিতা রঙে রাঙিয়ে যাতে পুজো করা হয়। দেবীর স্বপ্নাদেশ মেনে চট্টোপাধ্যায় পরিবার নীল দুর্গারই পুজো করে। আর সেই ধারা বজায় রেখে প্রতিবছর চট্টোপাধ্যায় পরিবার নীল দুর্গার পুজো করে আসছেন। তবে দুর্গার ন্যায় এখানে তার পরিবারের আর কেউ নীল বর্ণা নন।

বাংলার একমাত্র নীল দুর্গা পুজো কৃষ্ণনগরে - West Bengal News 24

নীল দুর্গা বাড়ির পুজোর একাধিক বিশেষত্বের মধ্যে আরেকটি হল দুর্গা প্রতিমার বাঁদিকে সরস্বতী ও গণেশের পাশাপাশি অবস্থান। আর দুর্গার ডান দিকে লক্ষ্মী ও কার্তিকের পাশাপাশি অবস্থান। সাধারণত মা দুর্গার সাথে তাঁর পরিবারের এই রূপ অবস্থান সচরাচর দেখতে পাওয়া যায় না। নীল দুর্গার অন্যান্য আচার অনুষ্ঠানেও ভিন্নতা চোখে পড়ে। উল্টো রথের দিন দেবীর পাটে মাটি দিয়ে হয় পাট-পুজো। ষষ্ঠীতে মন্দির প্রাঙ্গণে বেল গাছকে পুজো করে নীল দুর্গার পুজো শুরু হয়। দেবীর পুজো হয় শাক্ত মতে। সন্ধি পুজোতে ১০৮টি অপরাজিতা ফুল লাগে। পুজোর কটা দিন দেবীকে পরিবারের সদস্যের মতোই আদর যত্ন করে রাখতে হয়। পুজোর তিনদিন (সপ্তম, অষ্টমী, নবমী) দেবীকে মাছের বিভিন্ন পদ তৈরি করে ভোগ নিবেদন করা হয়। অবশ্যই সেই মাছ আঁশযুক্ত হওয়া চাই। মা-কে সপ্তমীতে সাত প্রকার ভাজা, অষ্টমীতে আট প্রকার ভাজা এবং নবমীতে নয় প্রকার ভাজা সহযোগে ভোগ দেওয়া হয়। আর দশমীর দিন অনেকটা পথ যেতে হবে বলে দেবীকে পান্তা ভাত খাইয়ে বিদায় জানানো হয়। সঙ্গে থাকে কচুর শাক, মটর ডালের বড়া, গন্ধরাজের বড়া। তবে নীল দুর্গার নিরঞ্জনে বিশেষ উল্লেখনীয় কোনো রীতি নেই। স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই দশমীর দিন কৃষ্ণনগরের জলঙ্গী নদীর বিসর্জন ঘাটে নীল দুর্গার ভাসান হয়।

উল্লেখ্য, সময়ের সাথে সাথে নীল দুর্গা বাড়ির পুজোর রীতিনীতিতে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। কুমারী পুজো এখন আর হয় না। আগে তাদের পুজোয় ঘটা করে মহিষ ও পাঁঠা বলি দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। তবে এখন সেভাবে পশু বলি হয় না। আদি নীল দুর্গা বাড়িতে কেবল একটি করে পাঁঠা বলি এখনো হয়। পশুবলির পরিবর্তে এখন ‘শত্রু বলি’ দেওয়া হয়। নবমীতে আতপ চালের গুঁড়ো দিয়ে মানুষ তৈরি করা হয়। চালের পিটুলিকে কাল্পনিক শত্রু মনে করে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা শত্রু নিধন করেন। চালের পিটুলিকে লাল শালুতে মুড়ে কচু পাতায় জড়িয়ে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের নেতৃত্বে ছেলেরা একসাথে খাঁড়া ধরে নয় কোপে বলি দেন। এইভাবে শত্রু নিধন হয়।

লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।

আরও পড়ুন ::

Back to top button

দয়া করে ওয়েবসাইটে বিজ্ঞাপনের অনুমতি দিন

দেখে মনে হচ্ছে আপনি কোনও বিজ্ঞাপন ব্লকার ব্যবহার করছেন। আমরা বিজ্ঞাপনের উপর ভরসা করি ওয়েবসাইটের ফান্ডের জন্য