প্রযুক্তি

জলবায়ু পরিবর্তনে ছোট হয়েছে মানব মস্তিস্ক: গবেষণা

জলবায়ু পরিবর্তনে ছোট হয়েছে মানব মস্তিস্ক: গবেষণা
জেফ মর্গান স্টিবেল এই ছবিটি ব্যবহার করেছিলেন মানব মস্তিষ্ক নিয়ে তার টেড টকের প্রচারণায়| ছবি জেফ মর্গান স্টিবেলের ফেইসবুক থেকে

অতীতে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ছোট হয়েছে মানব মস্তিষ্কের আকার – ৫০ হাজার বছরের মানব ফসিল এবং জলবায়ুর উপাত্ত ঘেঁটে করা এক গবেষণায় বেড়িয়ে এসেছে এমন তথ্য।

পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের সঙ্গে মানব প্রজাতির অভিযোজন ও বিকাশ বুঝতে গবেষণাটি করেন ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের স্নায়ু বিজ্ঞানী জেফ মর্গান স্টিবেল।

“জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে মানব মস্তিকের আকার এবং মোটাদাগে মানুষের আচরণের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তা বোঝাটা জরুরী” – প্রবন্ধে লেখেন স্টিবেল।

বৈশ্বিক উষ্ণতা, আর্দ্রতা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনে গত ৫০ হাজার বছরের বিভিন্ন সময়ের হোমো গণ এর ২৯৮টি নমুনার পরিবর্তন বুঝতে পরীক্ষাটি করা হয়েছে। শীতল সময়ের তুলনায় উত্তপ্ত জলবায়ুর সময়ে মানব মস্তিষ্কের গড় আকার উল্লেখযোগ্যভাবে কম, বলা হয়েছে গবেষণা প্রবন্ধটিতে।

মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’। এর মধ্যে ‘হোমো’ হচ্ছে গণ বা জেনাস এবং ‘স্যাপিয়েন্স’ হচ্ছে হোমোর অধীনে থাকা স্পিশিজ বা প্রজাতি। হোমো জেনাস বা গণের অধীনে স্যাপিয়েন্সসহ আরও অনেক প্রজাতি রয়েছে যেমন হোমো ইরেকটাস, হোমো নিয়ান্ডারথালেনসিস ইত্যাদি। বিজ্ঞানীরা এই গবেষণায় হোমো গণের অধীনে থাকা প্রজাতিগুলো নিয়ে গবেষণা করেছেন যার মধ্যে মানুষ বা স্যাপিয়েন্সও আছে।

মস্তিক সংকোচন নিয়ে তার আগের করা গবেষণাটিতে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব খুঁজতে এই অনুসন্ধানটি চালান স্টিবেল। তিনি বলেন, “সময়ের পরিক্রমায় মানব মস্তিকের আকার পরিবর্তন বুঝাটা খুবই জরুরী, কিন্তু এ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো কাজই হয়নি।”

“আমরা জানি লাখ লাখ বছর ধরে বিভিন্ন প্রজাতির মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটেছে কিন্তু সেই বিকাশের ছোট ছোট পর্যায়গুলোর ব্যাপারে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত।”

আগে প্রকাশিত ১০টি উৎস থেকে, ৫০ হাজার বছর সময় ব্যাপ্তির ২৯৮ টি মানব অস্থি নিয়ে মোট ৩৭৩টি পরিমাপ সংগ্রহ করেন স্টিবেল। অস্থিগুলো থেকে মস্তিষ্কের আকার অনুমান করতে তিনি ভৌগোলিক ভিন্নতা এবং লিঙ্গভেদের ওপর ভিত্তি করে দেহের আকার অনুমান করেন।

গবেষণাটিতে অস্থিগুলোকে চারটি কালের সীমানায় ভাগ করেছেন স্টিবেল। একশ বছর, পাঁচ হাজার বছর, ১০ হাজার বছর এবং ১৫ হাজার বছর।

তিনি মস্তিষ্কের আকারকে চারটি জলবায়ু নথির সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন, তার মধ্যে রয়েছে অ্যান্টার্কটিকায় বরফের কেন্দ্র অনুসন্ধান নিয়ে ইউরোপীয় প্রকল্প (ইপিআইসিআই) এর ‘সি গম্বুজে’র উপাত্ত্বও। গম্বুজটির কেন্দ্রের বরফ গত আট লাখ বছরের পৃথিবীপৃষ্ঠের তাপমাত্রা নিয়ে নির্ভুল তথ্য দেয় বলেছে সায়েন্স অ্যালার্টের একটি প্রতিবেদন।

ভূপৃষ্ঠে সর্বোচ্চ পরিমাণ বরফ হয়েছিলো ৫০ হাজার বছর আগে, ভূগোলের ভাষায় বলে এলজিএম বা লাস্ট গ্লেসিয়াল ম্যাক্সিমাম। সর্বশেষ প্লাইস্টোসিন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত যার কারণে গড় তাপমাত্রা ক্রমাগতভাবে কমতে থাকে। তারপর হলোসিন যুগের শুরু হলো এবং তারপর থেকে আজকে পর্যন্ত গড় তাপমাত্রা কেবল বাড়ছেই।

জলবায়ু পারিবর্তন বা তাপমাত্রার তারতম্যের সঙ্গে হোমো গণের মস্তিষ্কের আকার পরিবর্তনের সম্পর্ক বেরিয়ে এসেছে গবেষণাটিতে। হলোসিন বা উষ্ণ যুগ জুড়ে মানব মস্তিষ্ক গড়ে ১০ দশমিক সাত শতাংশের বেশি ছোট হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মস্তিষ্কের আকারে পড়তে হাজার হাজার বছর লাগে, এবং লাস্ট গ্লেসিয়াল ম্যাক্সিমামের পরে এই পরিবর্তন হতে লেগেছে ১৭ হাজার বছর।” প্রবন্ধটিতে ব্যাখ্যা করেন স্টিবেল।

“অভিযোজনের সময় একটি প্রজন্মকে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা পরবর্তী প্রজন্মে চলমান থাকে। কোনো কোনো প্রজাতির জন্য অভিযোজন প্রক্রিয়া অনেকগুলো প্রজন্মে চলমান থাকতে পারে।” মস্তিষ্কের এই পরিবর্তন ১৭ হাজার বছর আগে থেকে শুরু হয়ে পাঁচ হাজার বছর আগে পর্যন্ত ঘটেছে এবং গবেষণা বলছে, চলমান বৈশ্বিক উষ্ণতাও মানুষের স্নায়বিক গঠনের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। “এখন মস্তিষ্কের আকার যদি সামান্যও ছোট হয় তাতে মানুষের শারীরিক গঠনে কেমন পরিবর্তন ঘটাবে, তাবে তা নিয়ে এখনও আমাদের স্পষ্ট ধারণা নেই” –প্রবন্ধটিতে বলেছেন স্টিবেল।

গবেষণা প্রবন্ধটি বলছে আর্দ্রতা এবং বৃষ্টিপাতের পারিমাণ ও প্রভাব ফেলে মস্তিষ্কের বিকাশে। যদিও তাপমাত্রা সবচেয়ে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তারকারী উপাদান, তবে বড় আকারের মস্তিষ্কের সঙ্গে শুষ্ক পরিবশের কিছুটা সম্পর্ক রয়েছে বলে উঠে এসেছে গবেষণাটিতে।

কী কী বিষয় মানব মস্তিষ্কের আকারে প্রভাব রাখে তা নিয়ে এখনো প্রশ্ন রয়ে গেছে। গবেষণাটির ফলাফল বলছে, জলবায়ুর তারতম্যে হোমো গণের মস্তিষ্কের আকারের হেরফের ঘটলেও, বিবর্তন বৈচিত্র্য সৃষ্টিতে জলবায়ুর হাত নেই।

স্টিবেল বলছেন, শিকারের মতো বাস্তুতান্ত্রিক উপাদান, চাষাবাদ ও সামগ্রিক উৎপাদনের মতো পরোক্ষ জলবায়ু উপাদান অথবা সংস্কৃতি ও প্রযুক্তির মতো জলবায়ু বহির্ভূত উপাদান প্রভাব রাখতে পারে মানব মস্তিষ্কের আকারে।

“ফলাফল বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন হোমো গণের মস্তিষ্কের আকার এবং মস্তিষ্কের কিছু বিবর্তন সম্ভবত পরিবেশগত সংকটে টিকে থাকার এক ধরনের উপায় হতে পারে।”

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষ করে তাপমাত্রার তারতম্য বা আবহাওয়ার পরোক্ষ উপাদানের সঙ্গে হোমো গণের শারীরিক গঠনের পরিবর্তন নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন” বলেছেন তিনি।

গবেষণাটি ‘ব্রেইন বিহেভিয়ার অ্যান্ড ইভোলিউশন’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।

সূত্র : বিডিনিউজ

আরও পড়ুন ::

Back to top button