প্রযুক্তি

ইন্টারনেট কি পারে বিপন্ন ভাষাগুলোকে বাঁচাতে?

ইন্টারনেট কি পারে বিপন্ন ভাষাগুলোকে বাঁচাতে?

একটা সময় মনে করা হতো, ইন্টারনেট বিপ্লবের কারণে বড় ভাষাগুলোর চাপে পৃথিবীর ছোট ভাষাগুলোর বিলুপ্তিপ্রক্রিয়া দ্রুততর হবে। কেননা, সাধারণত তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো সংখ্যালঘু মানুষের ভাষা বাঁচিয়ে রাখতে বিনিয়োগ করে না। সেক্ষেত্রে অসংখ্য মানুষ তাদের মাতৃভাষায় যোগাযোগের অভ্যাস থেকে দূরে সরে যেতে পারে।

কিন্তু, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাষাবিলুপ্তির বদলে ইন্টারনেট বরং ভাষারক্ষায় কাজে লাগতে পারে, এমন কিছু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। একাধিক দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠান নানা পরিসরে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষা শেখার হরেক রকম অ্যাপ তৈরি করছে। এসব অ্যাপের অনেকগুলোতেই যেমন আছে বড় ভাষা শেখার ব্যবস্থা, তেমনি কিছু কিছু অ্যাপে ধীরে ধীরে ছোট অর্থাৎ কম ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভাষাকেও জায়গা দেওয়া হচ্ছে। ফলে আগামীতে ইন্টারনেট হয়ে উঠতে পারে ঝুঁকি ও বিলুপ্তির মুখে থাকা অনেক ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার অন্যতম উপায়।

ভাষাজরিপগুলো থেকে দেখা যায়, যদিও বিশ্বের ৬০ শতাংশের বেশি ভাষা আফ্রিকা বা আমেরিকা থেকে এসেছে, কিন্তু বর্তমান বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ ব্যবহার করেন এশিয়া বা ইউরোপের ভাষা। অর্থাৎ মূল ভাষাগুলোর প্রভাব কমে এসেছে।

জাতিসংঘের তথ্যমতে, বর্তমানে পৃথিবীতে কথ্যভাষার সংখ্যা ৭ হাজার। এর ৪০ শতাংশই ঝুঁকির মুখে। প্রতিবছরই বেশ কিছু ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার তালিকায় নাম লেখাচ্ছে। পৃথিবীর ৫ ভাগের ২ ভাগ মানুষই ইংরেজি বা মান্দারিনের মতো বড় ৮ ভাষার যে কোনো একটি ব্যবহার করে থাকে। বাকি ৩ ভাগ মানুষ ব্যবহার করে ৭ হাজার ভাষার যে কোনো একটি।

ঔপনিবেশিকতার কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মাতৃভাষার ব্যবহার কমে গেছে, এবং সেগুলোর অনেকগুলোই ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন করে সে সব ভাষা শেখার মধ্য দিয়ে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব শুরু করা সম্ভব। স্মার্টফোন ও কম্পিউটারে মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগই অসংখ্য ভাষাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে। কাজে আসতে পারে ভাষা শেখার বিভিন্ন অ্যাপগুলো।

মুঠোফোনে ভাষা শেখার এরকমই একটি অ্যাপ ‘ডুয়োলিঙ্গ’। এ ধরনের অ্যাপ কীভাবে সাহায্য করতে পারে, সে ব্যাপারে নিজের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে আইরিশ তরুণ নোয়াহ হিগস জানান, স্কুলে আইরিশ ভাষা শিখতে একদমই অপছন্দ করতেন তিনি। কেননা স্কুলে তা অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শেখানোর চেষ্টা করা হতো। যা সাধারণ মানুষের বলার ধরণ থেকে ভিন্ন।

কিন্তু, তাতে করে ডাবলিনের বাসিন্দা হিগসের মন থেকে আইরিশ ভাষার প্রতি ভালোবাসা কমে যায়নি। বর্তমানে বিশ্বে মাত্র ১২ লাখ মানুষ আইরিশ ভাষা ব্যবহার করে। এ ভাষাটিও ঝুঁকির মুখে। হিগস মনে করেন আরও অনেক মানুষের এ ভাষাটি শেখা উচিত। কিন্তু, সহজে কীভাবে সেটি সম্ভব, তার ভালো উপায় খুঁজছিলেন তিনি।

এরই মাঝে ফরাসি ভাষা শিখতে ‘ডুয়োলিঙ্গ’ অ্যাপ ব্যবহার করতে শুরু করেন আইরিশ এ তরুণ। এক পর্যায়ে তার মাথায় আসে, এই অ্যাপটি যারা তৈরি করেছে তারা যদি কখনো আইরিশ ভাষা শেখানোর কথা ভাবতো! এই ভাবনা থেকেই এ প্রতিষ্ঠানকে মেইল করে বসেন তিনি। মেইলের উত্তর না দিলেও, তা এড়িয়ে যায়নি ডুয়োলিঙ্গ কর্তৃপক্ষ।

হিগস জানান, ২০১৩ সালের শুরুর দিকে ডুয়োলিঙ্গে মাত্র ৫টি ভাষা শেখা যেত। কিন্তু ২০১৪ সালে আইরিশ ভাষা শেখার সুযোগ করে দেয় ডুয়োলিঙ্গ। এবং তাদের এই উদ্যোগ বেশ সফল হয়। বর্তমানে এতে আইরিশ ছাড়াও নাভাজো, হাওয়াইয়ানসহ বিপদের মুখে থাকা বিভিন্ন ভাষাশিক্ষার কোর্স অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিপন্ন ভাষাগুলো নিয়ে আরও অনেক নতুন পরিকল্পনা আছে এই অ্যাপ প্রতিষ্ঠাতাদের।

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ত্রিশটিরও বেশি ভাষা নিয়ে একটি লাইব্রেরি তৈরির পরিকল্পনা ডুয়োলিঙ্গের। তাতেও বেশ কয়েকটি বিপন্ন ভাষা অন্তর্ভুক্ত হবে।

এদিকে শুধু হিগস নন, অসংখ্য মানুষ ডুয়োলিঙ্গে আবেদন জানিয়েছেন, তাদের পছন্দের ভাষাটি শেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। বর্তমানে এতে এমন সুবিধাও যুক্ত হয়েছে যার মাধ্যমে যে কেউ তার মাতৃভাষা বা পছন্দের ভাষা শেখার কোর্স চালু করতে পারে।

ডুয়োলিঙ্গে ভাষা শেখা যায় বিনামূল্যে। নিয়মিত মাত্র পাঁচ মিনিটের ছোট্ট একটি লেসনেই একটি ভাষা বলা, শোনা, পড়া ও লেখা আয়ত্ত করা সম্ভব বলে মনে করে ডুয়োলিঙ্গ। বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থীই ভাষা শিখতে বইয়ের পাশাপাশি এ অ্যাপ ব্যবহার করে।

পৃথিবীর যে কোনো মানুষ যেন আনন্দের মধ্য দিয়ে সহজে ভাষা শিখতে পারে সেটাই ডুয়োলিঙ্গের লক্ষ্য। প্রথমদিকে যদিও তারা সেই ভাষাগুলোই শেখার সুযোগ করে দিয়েছে, যেগুলো শিখতে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বেশি। কিন্তু এখন তারা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ঝুঁকির মুখে থাকা ভাষাগুলো শেখার বন্দোবস্তে এগিয়ে আসতে চায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভাষা শেখার এমন অনেক অ্যাপ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কোনো একদিন ব্যাপক এক ভাষাবিপ্লবে অন্যতম প্রধান নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে এসব অ্যাপ!

আরও পড়ুন ::

Back to top button