বাংলার পটচিত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল প্রাকৃতিক উপাদান ও উপকরণের প্রয়োগে পট লেখা। হ্যাঁ, ‘পট লেখা’ কথাটি ব্যবহার করলাম তার কারণ হল পটুয়ারা আগে পটচিত্র আঁকা বলতে ‘পট লেখা’ কথাটিই ব্যবহার করতেন, বয়োজ্যেষ্ঠ পটুয়াদের কেউ কেউ আজও ‘পট লেখা’ কথাটি ব্যবহার করেন। আর এই পট লেখা হত ভেষজ রং দিয়ে।
পটুয়ারা তাদের আশেপাশের প্রকৃতি থেকেই এই রং জোগাড় করতেন। যে সময়ের কথা বলছি, কেমিকাল রং তখন ছিল না। এভাবেই পটশিল্প বাংলার অন্যতম ঐতিহ্যমণ্ডিত চিত্রশিল্প হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেয়। পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি জেলায় পটুয়াদের বসতি আজও দেখতে পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ পিতৃপুরুষের জীবিকা হিসেবে পটচিত্র আঁকার বিষয়টি এখনো বজায় রেখেছেন। সুতরাং, ঐতিহ্যমণ্ডিত পটচিত্রের অস্তিত্ব আজও গ্রাম বাংলায় রয়েছে।
তবে অঞ্চলবিশেষে এই পটচিত্রের নিজস্বতা চোখে পড়ে। আজও তারা প্রাকৃতিক উৎস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে রং তৈরি করে দেখাতে পারেন, সেটাই হল ভেষজ রং। সেই রং ব্যবহার করে পটুয়ারা আস্ত একটা পটচিত্র এঁকেও দেখিয়ে দিতে পারবেন। নয়াতে ফিবছর যে পটমায়া উৎসব হয়, সেখানে যেমন পটুয়ারা ভেষজ উপাদান থেকে কীভাবে রং সংগ্রহ করা হয় এবং তারপর সেই রং দিয়ে কীভাবে পটচিত্র আঁকা হয় সেই পুরো প্রক্রিয়াটি দেখিয়ে দেন।
বাঁকুড়া জেলার ভরতপুরে শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে কয়েকটি পটুয়া ঘর রয়েছে, তারাও প্রাকৃতিক উপাদান থেকে রং সংগ্রহ করে পটচিত্র আঁকেন। তবে অঞ্চলভেদে এই ভেষজ রং ব্যবহারে তারতম্য দেখতে পাওয়া যায় এবং স্থান বিশেষে পটুয়াদের নিজস্বতাও চোখে পড়ে। কয়েকটি জায়গায় যেমন পটুয়াদের নির্ভেজাল স্বীকারোক্তি থাকে— “আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা ভেষজ রং ব্যবহার করে পটচিত্র আঁকতেন, তবে এখন আমাদের পক্ষে আর ভেষজ রং ব্যবহার করা সম্ভব হয় না।”
ভেষজ রং তৈরিতে পটুয়া পরিবারের মেয়েদের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তারা ঘরোয়া পদ্ধতিতে এবং বিচিত্র সব প্রাকৃতিক সহজলভ্য উপাদান থেকে রং তৈরি করতে খুব পারদর্শী ছিলেন। কাজটি খুব সহজ ছিল না। অঞ্চলভেদে আবার প্রাকৃতিক সহজলভ্য উপাদানের পরিবর্তন হওয়ায়, বিভিন্ন অঞ্চলের পটচিত্রের রঙে অনেক সময় বিভিন্নতা খুঁজে পাওয়া যায়। কলেবর সীমিত হওয়ায় এই প্রতিবেদনে শুধুমাত্র মুর্শিদাবাদ জেলার পটচিত্রে ব্যবহৃত ভেষজ রংগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল—
লাল রং : সিঁদুর, গিরিমাটি, জবাফুল ইত্যাদির সাথে বেলের আঠা মিশিয়ে লাল রং তৈরি করা হত।
নীল রং : জামের রসের সাথে বেলের আঠা ও কাঠ কয়লার মিহি গুঁড়ো মিশিয়ে তৈরি করা হত কালচে নীল রং।
সবুজ রং : শিম পাতার রস থেকে এবং নীল ও হলুদ মিশিয়ে সবুজ রং তৈরি করা হত।
কালো রং : ধান সেদ্ধ হাঁড়ির ভুসা কালি ও লম্ফের কালির সাথে বেলের আঠা মিশিয়ে কালো রং তৈরি করা হত।
কমলা রং : লাল ও হলুদ রং মিশিয়ে কমলা রং তৈরি করা হত।
বর্তমানে মুর্শিদাবাদের পটুয়ারা প্রধানত বাজার থেকে কেনা রং ব্যবহার করে পটচিত্র আঁকেন। প্রাকৃতিক উপাদান থেকে রং তৈরি করে পট আঁকার প্রতি তাদের আর বিশেষ আগ্রহ নেই।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়।