বিচিত্রতা

যে দ্বীপে থাকেন সব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী, একমাত্র বাসিন্দা নারী

যে দ্বীপে থাকেন সব সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী, একমাত্র বাসিন্দা নারী

একসময় কারাগার হিসেবে ব্যবহার করা হত ইতালির পিয়ানোসা দ্বীপটি। বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবেই ব্যবহার করা হয় এটি। দ্বীপটিতে কেবল একজন নারীরই বাস। তাঁর নাম জুলিয়া মানকা।

তবে কোনো অপরাধের সাজা খাটার জন্য তিনি সেখানে যাননি।

ঘটনাটি খুলেই বলা যাক, ২০১১ সালে এই দ্বীপে প্রথম পা রাখেন জুলিয়া মানকা। তাঁর ইচ্ছা ছিল সমুদ্রে ঘেরা দ্বীপটিতে কয়েকটা দিন সময় কাটানো। কিন্তু সেখানকার সৈকতমুখী হোটেল মেলিনায় ওঠার পর পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেল।

তিররেনীয় সাগরের দ্বীপটিতে এক রকম স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন মানকা।

প্রথমবার গিয়ে মানকা যেই হোটেলে ওঠেন সেটি পরিচালিত হয় পর্যবেক্ষণে থাকা সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের দ্বারা। বর্তমানে হোটেলটির ব্যবস্থাপক এবং দ্বীপের পুনর্বাসন কর্মসূচির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কাজ করছেন তিনি। এই কর্মসূচি পরিচালনা করত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আরনেরা ও তাসকানির কারা কর্তৃপক্ষ।

মানকা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেন, ‘আমি হোটেলে এক সপ্তাহ কাটালাম এবং তারপর জায়গাটি ছেড়ে যেতে চাইলাম না। অসাধারণ ছুটি কেটেছিল এবং পুনর্বাসন প্রকল্পটি মুগ্ধ করে আমাকে। বন্দীরা দ্বিতীয় একটি সুযোগ পায় এখানে। আমি পিয়ানোসার প্রেমে পড়ে যাই—এর নীরবতা, এখানকার সাগরের স্বচ্ছ পানি, শান্ত তারাময় রাত—সবকিছুর।’

কর্সিকা ও মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অবস্থিত একসময় ডেভিল’স আইল্যান্ড বা শয়তানের দ্বীপ নাম পাওয়া দ্বীপটি অসাধারণ সুন্দর সৈকত এবং সবুজ গাছপালার জন্য পর্যটকদের পছন্দের একটি গন্তব্যে পরিণত হয়েছে এখন।

দ্বীপের স্থায়ী বাসিন্দাদের মধ্যে মানকা ছাড়া আছেন একজন কারা প্রহরী ও ১০ জন সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী। এই অপরাধীদের কেউ হোটেলটির রাঁধুনি, কেউ মালি, আবার কেউ ওয়েটার। দ্বীপে পর্যটকদের থাকার একমাত্র জায়গা এই হোটেলই।

পাইনগাছে ঘেরা হোটেল মিলেনায় চমৎকার কাঠের আসবাবে সজ্জিত ১১টি কক্ষ রয়েছে। কক্ষগুলো থেকে সাগরের অসাধারণ দৃশ্যও নজর কাড়ে। এ ছাড়া এখানে রয়েছে চমৎকার একটি রেস্তোরাঁ এবং একটি পানশালা।

হোটেলটি সারা বছরই খোলা থাকে। ২০১১ সালে মানকা যখন হোটেলটিতে তখন ওই সময়কার ম্যানেজার তাঁকে জানান যে সংস্থাটি (আরনেরা) আর্থিক সমস্যায় আছে এবং হোটেলটি বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমনটা হলে বন্দীদের আবার কারাগারে স্থানান্তর করা ছাড়া উপায় থাকবে না।

একসময় টুরিস্ট এজেন্ট হিসেবে কাজ করা মানকা বলেন, ‘আমি অনুভব করলাম যে তাঁদের সাহায্য করার জন্য আমার কিছু করা উচিত। না হয় নতুন করে শুরুর সুযোগ ছাড়াই কারাগারে চলে যেতে হবে এসব বন্দীদের। তেমনি মুক্তি পাওয়ার পর সাহায্য করতে পারে এমন কোনো কাজও শেখা হবে না।’

তাসকানিতে বেড়ে ওঠা মানকা এখানে থাকার এবং হোটেলের ম্যানেজারের দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি প্রথমে বিনা বেতনে কাজ করেন এখানে। পাশাপাশি হোটেলের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য তাঁর পরিচালনার দক্ষতা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেন। দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি পাল্টে দিলেন মানকা। হোটেল মিলেনা হয়ে উঠল বিয়ে ও জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজনের জনপ্রিয় জায়গা।

১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দ্বীপটি সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থার একটি কারাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এরপরই এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এখানে থাকা অল্প কিছু কয়েদিকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দেওয়া হয় তখন। পিয়ানোসা এরপর অনেকগুলো বছর পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছিল।

দ্বীপে একটা সময় বিশেষ অনুমতি নিয়ে নির্দিষ্ট ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে একসঙ্গে একটি নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা হতো মাঝেমধ্যে। পরে আবার একে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

এই হোটেলে যেসব সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি থাকেন তাঁদের একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। হোটেল মিলেনার পুনর্বাসন প্রকল্পে সুযোগ পাওয়ার জন্য আবেদনকারীদের অবশ্যই তাঁদের শাস্তির অন্তত এক-তৃতীয়াংশ জেলে থাকতে হবে। কঠোর মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক মূল্যায়ন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হতে হয়।

গত ১২ বছরের বেশি সময়ে মিলেনায় বিভিন্ন অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত প্রায় ১০০ অপরাধী অবস্থান করেছেন। তাঁরা এখানে বন্দী থাকার পরিবর্তে কাজ করেছেন।

এখন ‘পিয়ানোসার রানি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন মানকা। তিনি বলেন, তাঁর এই চাকরি, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভ্রু কুঁচকে দেয়। অপরাধী পরিবেষ্টিত অবস্থায় একমাত্র নারী হিসেবে এখানে থাকার ঝুঁকির বিষয়টিই তাঁরা মনে করিয়ে দেন।

মানকা বলেন, মানুষজন বলতেই থাকে, এমন একটা চাকরি নেওয়া পাগলামি ছাড়া কিছু নয়। কখনোই এখানে থাকা নিয়ে ভয় পাননি বা চিন্তিত হননি তিনি। বরং শহরের চেয়ে অপরাধীদের সঙ্গে এই দ্বীপে বেশি নিরাপদ বোধ করেন।

মানকা জানান, প্রতি সপ্তাহে একবার তিনি সকালের ফেরিতে চড়ে মূল ভূখণ্ড তাসকানিতে যান। সময় লাগে তিন ঘণ্টা। হোটেল-সংক্রান্ত সেখানকার বিভিন্ন কাজ শেষে রাতেই ফিরে আসেন।

এখানে যেসব অপরাধীরা কিন্তু ফ্রিতে কাজ করেন না। তাঁদের মাস হিসেবে বেতন দেওয়া হয়। পুরোনো জেল কোয়ার্টারে থাকেন তাঁরা। সেখানে আছে জিম, টিভি, বাথরুমসহ ব্যক্তিগত কামরা, রান্নাঘর। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য মোবাইল ফোনও দেওয়া হয়।

মানকা জানান, দ্বীপে কয়েকটা বছর কাটিয়ে মুক্তি পাওয়াদের অপরাধের হার শূন্যের আশপাশে। কেউ কেউ এখানে পাঁচ থেকে দশ বছর কাটিয়েছেন। তিনি এখান থেকে গিয়ে নতুন জীবন শুরু করা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন।

মানকা বলেন ‘আমার মেয়ে ইয়োলান্দা, যে ছোটবেলায় আমার কাজের প্রতি কিছুটা সন্দেহপ্রবণ ছিল, সেও দ্বীপটির প্রশংসা করে এখন। আমি যা করি, তার গুরুত্ব ও বুঝতে পেরেছে। এখন বলে যে, আমি একজন ভাগ্যবান মানুষ।’

আরও পড়ুন ::

Back to top button