পর্যটন

ভ্রমনপিপাসুদের কাছে সুন্দরবন এক মনোরম স্থান, আসুন জেনে নিই সুন্দরমন ভ্রমনের আদ্যোপান্ত

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

ভ্রমনপিপাসুদের কাছে সুন্দরবন এক মনোরম স্থান, আসুন জেনে নিই সুন্দরমন ভ্রমনের আদ্যোপান্ত - West Bengal News 24

সারা পৃথিবীর ইতিহাসে দেবকুল্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভ্রমণপিপাসুদের একটাই নাম সুন্দরবন অথচ আমরা সুন্দরবনের ছেলে হয়েও সুন্দরবনের গুরুত্ব প্রথম থেকে কোনদিন বুঝতে চাইনি বা বুঝতে পারিনি। শত বাধা অতিক্রম করে নিজের তাগিদেই কলকাতায় থাকতে থাকতে সুন্দরবনের গুরুত্ব অপরিসীম সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার সুপরিচিতি বন্ধুর হাত ধরে সুন্দরবনে যাওয়ার ব্যবস্থাটা বিনা পয়সায় করে নিয়েছিলাম লঞ্চ মালিক বিষ্ণু ঘোষের এর মাধ্যমে। বিষ্ণু ঘোষ ক্যানিংয়ের ছেলে বিডিও অফিসে বাসন্তীতে তথ্যমিত্র কেন্দ্র চালাতো, সেই থেকে আমার সঙ্গে পরিচিতি। সুন্দরবন এ ঘুরতে যাওয়ার আগে সুন্দরবন সম্পর্কে যতটুকু আমি জানতে চেয়েছিলাম বা বুঝতে পেরেছিলাম। ইচ্ছে ছিল এমন এক জায়গায় যাওয়ার যেখানে নদী আর গহীন অরণ্যের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যাবে! যেখানে বন্যপ্রাণী প্রতিনিয়ত সবুজ দুনিয়ায় খেলা করে, ভোরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। যেখানে গেলে সাগর, নদী আর সবুজ বনানীর মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে একটুও আফশোস হবে না! সেই নীল আকাশ, নদী আর অরণ্যের মহামিলন দেখতেই সুন্দরবনে যাওয়া। গিয়ে যা জানতে পারলাম তা আজ এই লেখাতে স্পষ্ট করতে চলেছি।

সুন্দরবনকে উপজীব্য করে তৈরি আধুনিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে সরলা বসুর ‘জল বন্যের কাব্য’ স্বতন্ত্র। বিভূতিভূষণকে উৎসর্গ করা বইটি ১৯৫৭ সালে তার পরিণত বয়সে লেখা হলেও অভিজ্ঞতা কৈশোরের। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মাত্র ১১ বছর বয়সে কয়েক দিনের নদীপথে লেখিকা এসেছিলেন সুন্দরবনে। বন কর্মকর্তা স্বামীর সঙ্গে থেকেছেন বাদাবনের সুপতি, চাঁদপাই, কপোতাক্ষী, বুড়ি গোয়ালিনী, নলগোড়া ফরেস্ট রেঞ্জে। উপন্যাসকে অবশ্য লেখিকা নিজেই সাহিত্যকর্ম বলতে রাজি নন। এ তার রঙের তুলিতে আঁকা কৈশোরের ছবি, স্মৃতির রেখায় সে ছবিরই দাগ জল বনের কাব্য। সপ্তাহখানেক ধরে সাত নদীর মোহনা হয়ে নদীপথে প্রথম পৌঁছেছিলেন বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জে। কয়েক দিনের যাত্রাপথে দেখার মধ্যে মাতলা নদী, ন-বেকীর হাঁট, গাঘেঁষা বন, নোনা জলে জন্মানো সদ্য চেনা গাছের বাতাস, বন ও নদীনির্ভর মায়া বিবির মতো নানা গ্রামের হাটের নতুন খাবারের স্বাদ, বদলে যাওয়া টানে পরিবর্তিত ধারার আঞ্চলিক ভাষা সবই মনে রেখেছিলেন ছবির মতো। জীবনের এই উপকরণ গ্রহণ করতে করতে লেখিকার কাছে উপস্থিত হয়েছে সমাজের অচেনা একশ্রেণীর মানুষের জীবন। বাওয়াল, মৌয়াল, রাঁধুনি, ফকির, সন্ধিবুড়ি এমনকি তৎকালীন ইংরেজ বন কর্মকর্তার গল্প পেয়েছেন সরলা বসু। কৈশোরে চঞ্চলতা ও সরলতা নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন চারপাশ আর লিখেছেন নিজের জন্য, তাই তার জল বনের কাব্য সরল হয়েও গভীর ও আন্তরিক। আজ সাহিত্য বিষয় নিয়ে আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়, সুন্দর বনে ঘুরে এসে তার ঠিক ৫ বছর পরে তার সৌন্দর্যের কথা তুলে ধরা ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে সেটাই ছিল এই লেখার উদ্দেশ্য! সুন্দরবনকে আমি যেভাবে চিনেছি ,বা দেখেছি উপভোগ করেছি! সুন্দরবন সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত, জল আর জঙ্গলের অসাধারণ সমন্বয়ের জন্য বিখ্যাত, প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের জন্য বিখ্যাত, বাঘের নদী পেরিয়ে গ্রামে এসে হামলা চালানোর জন্য বিখ্যাত, জঙ্গলে মধু বা কাঠ আনতে গিয়ে বাঘের কবলে পড়ে মানুষের মৃত্যুর জন্য বিখ্যাত, সামান্য টাকার জন্য মানুষের চরম বিপদের ঝুঁকি নেওয়ার জন্য বিখ্যাত, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের লড়াইয়ে মানুষের পরাজয়ের জন্য বিখ্যাত, আবার সেই পরাজয়কে পাথেয় করে জীবনসংগ্রামে মানুষের জয়ী হওয়ার জন্যও বিখ্যাত।

আরও পড়ুন : কংসাবতীর তীরে মন্দিরময় লালগড়

যদিও সুন্দরবনে সারাবছরই পর্যটক যায় কিন্তু ঘোরাঘুরির জন্য শীতকালটাই সবথেকে ভালো। এইসময়ে এখানে ভিড় হয় ঠিকই কিন্তু তাতে ঘোরাঘুরির সেরকম কোনও অসুবিধে হয় না। কলকাতা থেকে খুব কাছে সুন্দরবন একটা দূর্দান্ত ঘোরার জায়গা। জল, জঙ্গল, জন্তু, প্রকৃতি এই চারটের কোনও একটাও যদি কারুর জন্য ঘোরার পক্ষে যথেষ্ট কারণ বলে মনে হয়, তাহলে তাকে একবার সুন্দরবন যেতেই হবে ! তবে মাতলার নাব্যতা দিনে দিনে কমছে। এখন এমনই অবস্থা যে, ক্যানিং থেকে ভাটির সময় আর ট্যুরিস্ট লঞ্চ ছাড়তে পারেনা। সেই সোনাখালি থেকে ছাড়ে। ক্যানিং থেকে সোনাখালির দূরত্ব প্রায় ১০ কিমি। শিয়ালদা থেকে ক্যানিং পর্যন্ত ট্রেনে গিয়ে, সেখান থেকে সোনাখালি অটোতে যাওয়া যেতে পারে। শিয়ালদা, পার্ক সার্কাস, বালিগঞ্জ, ঢাকুরিয়া, যাদবপুর, গড়িয়া, সোনারপুর থেকে একে একে বন্ধুরা জুড়ে জুড়ে আমরা এখন ২৭ জনের বড় দল। ক্যানিং পৌঁছে গেলাম সকাল ৮ টার মধ্যেই। কিন্তু ওই বিপত্তি, জোয়ার না আসা পর্যন্ত ক্যানিং থেকে লঞ্চ ছাড়েনা, সোনাখালিতেই যেতে হবে। অতএব হই হই করে অটোরিক্সা ভাড়া করে রওনা দিলাম সোনাখালির উদ্দেশ্যে। আমি পৌঁছেছিলাম বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে একটু অন্যভাবে।

ভ্রমনপিপাসুদের কাছে সুন্দরবন এক মনোরম স্থান, আসুন জেনে নিই সুন্দরমন ভ্রমনের আদ্যোপান্ত - West Bengal News 24

কলকাতা – সকাল ৭ঃ৩০ মিনিটে গাড়ি – ভায়া বারুইপুর, ক্যানিং – সকাল ১১ঃ৩০ মিনিটে সোনাখালি – লঞ্চে গোসাবা হয়ে বিকেল ৫ঃ৩০ মিনিটে পাখিরালয় – পাখিরালয়ে রাত্রিবাস
২৫শে ডিসেম্বর, ২০১৫: সকাল ৮ঃ৩০ মিনিটে লঞ্চে – সজনেখালি, সুধন্যখালি, দোবাঁকি – সন্ধ্যে ৭টায় পাখিরালয়ে ফিরে রাত্রিবাস
২৮শে ডিসেম্বর, ২০১৫: সকাল ৯টা লঞ্চে – ঝড়খালি – সন্ধ্যে ৬ঃ৩০ মিনিটে সোনাখালি – গাড়িতে ভায়া ক্যানিং, বারুইপুর – রাত ৯ঃ৩০ মিনিটে কলকাতা

আমরা সুন্দরবনে গিয়ে বাঘ দেখতে পেয়েছি (হ্যাঁ, কোনওরকম সূচনা, ভনিতা না করে শুধু এই চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েই শুরু করছি এবারের লেখা। কবে, কোথায়, কিভাবে সেসব জানতে গেলে অবশ্য পুরো লেখাটা পড়তে হবে !) । ২৬শে ডিসেম্বর, ২০১৫ বছরের শেষ তিনটে দিন জলে-জঙ্গলে কাটানোর জন্য আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম সুন্দরবনের উদ্দ্যেশ্যে। আমাদের এ’বারের দল ৪ জন আর কলকাতা থেকে ৮ জন মোট ১২ জনের। আলাদা করে আর কারুর নাম উল্লেখ করছি না, তবে আমরা যারা নিয়মিত একসঙ্গে যাই, তারা সবাই ছিলাম। ১২ জনের দল মানে একটা ছোটখাটো কন্ডাক্টেড ট্যুরই বলা যেতে পারে। এর আগে চাঁদিপুরে আমরা এরকম বড় দল নিয়ে গিয়েছিলাম, তবে সেখানে সবাই ছিল সমবয়স্ক এবং সেইহেতু কিছুটা সমমনস্ক। এবারের দলে সবাই ছিল, তাই সবটা ম্যানেজ করার কাজটা সহজ ছিল না, তবে এটা বলতে পারি সবমিলিয়ে সবকিছু ভালোভাবেই হয়েছে। ২৪শে ডিসেম্বর, ২০১৭ সকাল ৭ টার সময়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ১২ জনের সবাই এক জায়গায় থাকে না, তাই মোট তিনটে টাটাসুমো আর একটা উইঙ্গার কলকাতার বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজনদের তুলে নিয়ে সোনাখালির উদ্দেশ্যে রওনা হল। আমাদের বাড়ি থেকে সোনাখালির দূরত্ব ২২ থেকে ২৪ কিলোমিটারের মতো, কিন্তু তাও পৌঁছতে প্রায় ঘন্টাচারেক লেগে গেল (মাঝে আমরা একবারই চা খাওয়ার জন্য আধঘন্টা দাঁড়িয়েছিলাম)। গাড়ি আমাদের সোনাখালির ঘাটের কাছে নামিয়ে দিল। এই সোনাখালির ঘাট থেকে আমাদের লঞ্চ ছাড়ার কথা। সেখানে পৌঁছে দেখলাম যেন মেলা বসেছে। ডিসেম্বরের শেষের কয়েকটা দিন সুন্দরবনে প্রচুর লোক যায় এটা শুনেছিলাম, কিন্তু সেটা যে কত বেশি তার স্পষ্ট ধারণা ছিল না। জেটিতে একেকটা লঞ্চ লাগছে, হুড়মুড় করে লোক উঠছে, লঞ্চ জেটি ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কোনও লঞ্চের যদি লোক বা মালপত্র তুলতে একটু বেশি সময় লাগে, তাকে বাকি লঞ্চের কর্মচারীরা বকাবকি করছে। যাই হোক, এইরকম তাড়াতাড়ি করেই আমরা আমাদের লঞ্চে উঠে পড়লাম। লঞ্চের আপার ডেকলঞ্চ জিনিসটায় আমি এর আগে ক্যানিং থেকে সোনাখালী যাওয়ার সময়ে চড়েছি, কিন্তু এই লঞ্চগুলো ঠিক সেরকম নয়, এখানে লোয়ার ডেক আর আপার ডেক আছে – লোয়ার ডেকে পাঁচটা ডাবল্‌ বেড রয়েছে যেখানে ইচ্ছে করলে দশ-বারোজন অনায়াসে শুতে পারে। এছাড়া লোয়ার ডেকে একটা টয়লেটও আছে। আপার ডেকে চেয়ার পাতা, খাওয়ার জায়গা ইত্যাদি রয়েছে। লোয়ার ডেকটা চারদিক ঘেরা, কয়েকটা জানালা আছে। আপার ডেকটা চারদিক খোলা। ভিউ দেখার জন্য আপার ডেকটা অনেক ভালো, তাই বেশিরভাগ লোকজন আপার ডেকেই বসলাম। সকল সাতটা নাগাদ আমাদের লঞ্চ ছাড়ল সোনাখালির জেটি থেকে। লঞ্চের ওপরে রোদ লাগে, কিন্তু ডিসেম্বরের শেষে গরম সেরকম লাগে না, তাই ব্যাপারটা খুব উপভোগ্য। আমরা লঞ্চে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যেই লুচি-তরকারি দিল।

আমাদের ভ্রমণ তিনদিনের, তৃতীয়দিন সন্ধ্যেবেলা আবার সোনাখালিতে এসে আমাদের যাত্রা শেষ হবে। এই তিনদিন আমাদের লঞ্চে ঘোরা, রাত্রে হোটেলে থাকা, সারাদিনের খাওয়া – সবমিলিয়ে মাথাপিছু খরচ ৩,৮৫০/- । আমার বেলায় বিষ্ণুপদ ঘোষ লঞ্চ মালিক আমার বন্ধু ছিল এক টাকাও লাগেনি। বিষ্ণুর হাত ধরে এটা আমার দ্বিতীয় বার সুন্দরবন যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। লঞ্চ থেকে পাড়ের দৃশ্য লঞ্চে বসে দুদিকের দৃশ্য দেখতে দেখতে আর ছবি তুলতে তুলতেই সময় কেটে যায় আর বিশেষ করে এই ধরনের দৃশ্য যা আমি অন্ততঃ কোনওদিন দেখিনি। নদীর জলের ওপর দিয়ে লঞ্চ এগিয়ে চলেছে আর দু’পাশে কখনও লোকালয়, কখনও ফাঁকা জায়গা আর কখনও বা গাছপালা। জঙ্গল জিনিসটা তখনও সেভাবে শুরু হয়নি । কিছুক্ষণ পরে লঞ্চে আমাদের মাছভাজা দিল। এইভাবে প্রায় দুঘন্টা চলার পরে আমাদের লঞ্চ একটা বড় নদীতে পড়ল – নদীর নাম বিদ্যাধরী নদী (ছোটবেলায় ভূগোল বই-এ পড়া হুগলী নদীর একটা শাখানদীর নাম, মনে পড়ছে ?) । এখানেই আমাদের প্রথম ভিউ পয়েন্ট – গোসাবা। গোসাবায় জেটিতে আমাদের লঞ্চ থামার পর আমরা লঞ্চ থেকে নামলাম। এখানে দেখার জায়গা প্রথমতঃ দু’টো – হ্যামিলটন-এর বাংলো আর বেকন বাংলো। হ্যামিলটন বাংলো জেটি থেকে নেমে মিনিট দশেক হেঁটে আমরা প্রথমে হ্যামিলটনের বাংলোয় পৌঁছলাম। ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিলটন এখানে এসে ছিলেন এবং গোসাবার অনেক উন্নতি করেন। বাংলোর ভিতরে ঢোকা যায় না, দরজাগুলো বন্ধ থাকে। তবে জায়গাটা বেশ সুন্দর। বাংলোর সামনে একটা বড় পুকুর রয়েছে। আমরা এখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে এগিয়ে গেলাম আমাদের পরবর্তী দেখার জায়গা – বেকন বাংলোর দিকে। বেকন বাংলো হ্যামিলটন বাংলো থেকে হেঁটে পনেরো মিনিট মতো লাগে। এখানকার বৈশিষ্ট্য হল স্যার হ্যামিলটনের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালের ৩০ ও ৩১শে ডিসেম্বর এই বাংলোয় দুদিন ছিলেন। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা বেশ বড় মূর্তি আছে। বাংলোর সামনে একটা বড় মাঠ আর পুরোটা একটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। এখানেও বাংলোর ভিতরে ঢোকা যায় না । বেকন বাংলো থেকে বেরিয়ে আমাদের আর আগের জেটিতে ফিরে যেতে হল না কারণ এখানে পাশেই আরেকটা জেটি আছে আর আমাদের লঞ্চ ইতিমধ্যেই এই জেটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আমরা লঞ্চে উঠে পড়ার পর লঞ্চ ছেড়ে দিল। দুপুর তিনটে বাজে, খিদেও পেয়েছিল আর লঞ্চে উঠেই দেখলাম লাঞ্চ রেডি। একেকবারে ১২-১৩ জন একসঙ্গে বসে লাঞ্চ করা যায়। দুপুরের মেনু ছিল ভাত, ডাল, ভাজা, ভেটকি মাছের ঝোল, চাটনি ইত্যাদি। খাবার অপরিসীম অর্থাৎ যত চাইবে ততই দেওয়া হবে। এমনকি কেউ কেউ চাইলে মাছও একটার বেশি দিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা এখানে নেমন্তন্ন খেতে আসিনি, এসেছি সুন্দরবন ঘুরতে তাই অপ্রয়োজনীয়ভাবে অতিরিক্ত ভোজন শুধু অস্বাস্থ্যকরই নয়, কিছুটা বিরক্তিকরও বটে ।

নদীর ওপরে সূর্য্যাস্তলাঞ্চ শেষ করতে করতে সাড়ে চারটে বেজে গেল। তারপরে আমাদের একটা করে কমলালেবু দিল । শীতকালের বিকেল তাড়াতাড়ি শেষ হয়, সাড়ে পাঁচটার পরেই সূর্য্য অস্তাচলে চলে গেল। জলের ওপর থাকা অবস্থায় এই সূর্য্যাস্তের দৃশ্য অসাধারণ লাগে বিশেষ করে এই দৃশ্য আমাদের সচরাচর দেখার সুযোগ হয় না। লঞ্চ বিদ্যাধরী নদী থেকে একটা খাঁড়ি ধরে দত্তা নদীতে এল। এই দত্তা নদীর ধারেই পাখিরালয় – আমাদের রাত্রিবাসের জায়গা। পাখিরালয়ের জেটিতে আমাদের লঞ্চ এসে পৌঁছল তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। লঞ্চ থেকে নেমে পাড়ে উঠে প্রথমেই যে লজটা সামনে পড়ে, সেটাই আমাদের। নাম চিতল লজ। এখানে মোট দশটা ঘর আছে আর সবকটাই আমরা নিয়েছি। দশটার মধ্যে ছটা চার বিছানা আর চারটে দুই বিছানা। আমরা আমাদের সুবিধেমতো ঘর ভাগ করে নিলাম। সন্ধ্যের জলখাবার ছিল মুড়ি বেগুনী, প্রত্যেকের ঘরে গিয়ে গিয়ে সেগুলো দিয়ে আসা হল। সন্ধ্যেবেলা আমাদের আর কিছু করার নেই, তাই আমরা কয়েকজন পায়ে হেঁটে একটু কাছাকাছি ঘুরতে গেলাম। পাখিরালয় জায়গাটা প্রায় গ্রামই বলা যেতে পারে, তবে সুন্দরবনে ঘুরতে এলে এখানে ট্যুরিস্টরা থাকে বলে বেশ কিছু হোটেল/রিসর্ট রয়েছে। আমরা হাঁটতে হাঁটতে পাখিরালয় বাজারে চলে গেলাম। এখানে যাওয়ার পথে একটা জায়গা আছে, সেখান থেকে দেখা যায় নদীর ওপরে অনেকগুলো লঞ্চ তাদের যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে মাঝনদীতে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাতের অন্ধকারে লঞ্চগুলোকে বিশেষ ভালো করে দেখা যায় না কিন্তু তাদের ভিতরের আলো দেখা যায়। আর অন্ধকারের মধ্যে এই নানারকম রঙের আলো দেখতে বেশ সুন্দর লাগে, দেখে মনে হয় নদীর ওপরে আলোর মেলা বসেছে। আমরা আমাদের লঞ্চের গাইডের থেকে জেনেছিলাম রাত্রিবেলা কোনও লঞ্চই ঘাটের কাছে থাকে না, সবাই মাঝনদীতে চলে গিয়ে নোঙর ফেলে দেয়। এটা করার কারণ হল রাত্রে যখন জোয়ার আসে তখন জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকাটা ঝুঁকির, কারণ জলের তোড়ে লঞ্চের ধাক্কায় জেটি ভেঙ্গে যেতে পারে আবার লঞ্চের ক্ষতিও হতে পারে। বাজার থেকে ফিরে এসে আমরা কিছুক্ষণ ঘরে ঘরে আড্ডা মেরে কাটালাম। রাত দশটা নাগাদ আমাদের রাতের খাবার দিল। আমাদের লজের ঘরগুলোর সামনে একটা লন আছে, সেখানে একটা চাঁদোয়া টাঙানো জায়গায় খাওয়ার ব্যবস্থা। রাত্রিবেলা এখানে বেশ ভালো ঠান্ডা পড়ে, তাই গরম গরম খাবার খুব দরকার ছিল। আর সেই খাবার যদি হয় ভাত বা রুটির সঙ্গে খাসীর মাংস, তাহলে তো কথাই নেই। খাওয়ার পরে যে যার ঘরে গিয়ে আমরা শুয়ে পড়লাম।পাখিরালয়ে সকালের কুয়াশা পরের দিন কার মানে হয় না, তাই আমি ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ঘরের বাইরে এসে দেখি চারিদিক ঘন কুয়াশায় ঢাকা। আমি লজের বাইরে এসে দেখলাম জলের ওপরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। চারপাশটা কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আবার লজে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের লঞ্চ পাড়ে এসে ভিড়ল আর আমাদের গাইড চা নিয়ে ঘরে ঘরে সবাইকে দিয়ে দিল। সকালে সবাইকে আটটার মধ্যে রেডি হয়ে নিতে বলা হয়েছিল, কারণ আমাদের বেরোতে হবে। এখানে বাথরুমে গিজার নেই, তবে একজন লোক আছে যে ঘরে ঘরে বালতি করে গরম জল দিয়ে যা । চানটান করে রেডি হয়ে লঞ্চ ছাড়তে ছাড়তে প্রায় পৌনে নটা বেজে গেল। সজনেখালির ওয়াচ্‌টাওয়ার থেকে পাখিরালয় থেকে বেরিয়ে আমাদের প্রথম গন্তব্য হল ‘সজনেখালি’। জায়গাটা বলতে গেলে নদীর ও’পারেই, নদী পেরোতে মিনিট পনেরো লাগল। সজনেখালিতে ইকো-ট্যুরিজম কমপ্লেক্স আছে। এখানে একটা ওয়াচ্টাওয়ার আছে, যদিও সেখান থেকে গাছের মাথা ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। এখানে আমরা সুন্দরী গাছ দেখলাম। গাছটার আলাদা কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, তবে কান্ডটা বেশ সুন্দর দেখতে। হয়তো এই কারণেই এর এই নাম। এখানে পাশে একটা জলাশয় আছে, সেখানে আমরা একটা গোসাপ আর একটা কুমীর দেখতে পেলাম। এছাড়া একটা ছোট মিউজিয়াম আছে, সেখানে কিছুক্ষণ থেকে আমরা বেরিয়ে এলাম।

ভ্রমনপিপাসুদের কাছে সুন্দরবন এক মনোরম স্থান, আসুন জেনে নিই সুন্দরমন ভ্রমনের আদ্যোপান্ত - West Bengal News 24

শ্বাসমূল সুন্দরবন অঞ্চলে সুন্দরী-গরাণ-গেঁওয়া প্রভৃতি গাছ দেখা যায়। এইসব গাছ নোনামাটি থেকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রয়োজনীয় জল এবং অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে না বলে এদের মূলের একটা অংশ মাটির উপরে বেরিয়ে আসে। এগুলোকে বলে শ্বাসমূল । একজায়গায় অনেকটা জায়গা জুড়ে এরকম শ্বাসমূল রয়েছে। আমাদের গাইড বলল এগুলোর ওপর দাঁড়াতে। দেখে জিনিসগুলোকে খুব একটা শক্ত বলে মনে হয় না, কিন্তু দাঁড়িয়ে দেখলাম খুবই শক্ত। আমাদের গাইড বলল বাঘ যখন মানুষ বা অন্য কোনও প্রাণীকে ধরে, তখনও তার শরীরে প্রাণ থাকে। তারপর বাঘ এইরকম শ্বাসমূলের ওপর দিয়ে তার শরীরটা বয়ে নিয়ে যায়। এই শ্বাসমূলগুলো তখন সেই শরীরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় আর প্রচন্ড যন্ত্রণায় বেশিরভাগ সময়েই সেই প্রাণীর শরীর থেকে প্রাণ বেরিয়ে যায়।

সজনেখালিতে যে জেটিতে লঞ্চ নামায় সেখান থেকে তোলে না। এখানে ঢোকার আর বেরোনোর গেট আলাদা আর আমাদের লঞ্চ আমাদের জন্য বেরোনোর গেটের জেটিতে অপেক্ষা করছিল। আগেই বলেছি বছরের শেষের এই কটা দিনে সুন্দরবনে প্রচন্ড ভীড় হয়, আর এই সজনেখালির জেটিতেও আগের দিনের সোনাখালির মতোই লোক গিজগিজ করছে। আমরা আমাদের লঞ্চে ওঠার পর লঞ্চ এগিয়ে চলল পরবর্তী গন্তব্য সুধন্যখালির দিকে।

সুধন্যখালি যাওয়ার পথে সজনেখালি থেকে সুধন্যখালি লঞ্চে প্রায় ঘন্টাতিনেক লাগে। লঞ্চে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের ব্রেকফাস্ট দিয়ে দিল। মেনুতে ছিল কচুরি আর তরকারি। লঞ্চে খাওয়াদাওয়াটা ভালোই হয় আর আমাদের রাঁধুনির রান্নার হাতটাও চমৎকার, তাই খাওয়াটা বেশ মনোমতোই হয়। ব্রেকফাস্টের কিছুক্ষণ পরে আমাদের আবার চিকেন পকোড়া দিল।

লঞ্চে করে জার্ণির একটা বৈশিষ্ট্য হল এখানে দৃশ্যপট প্রায় একইরকম – আমরা একটা সরু বা চওড়া বা খুব চওড়া নদীর একটা ধার ধরে এগিয়ে যাচ্ছি আর দুপাশে প্রধানতঃ জঙ্গল, মাঝে মাঝে লোকালয়। কিন্তু এই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও কখনও একঘেয়ে লাগে না। ঘন্টার পর ঘন্টা জলের ওপর লঞ্চে করে যাওয়াটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা আর আমরা সেই অভিজ্ঞতা পুরোমাত্রায় উপভোগ করেছি। প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ আমরা পৌঁছলাম সুধন্যখালিতে। এখানে জঙ্গলের মধ্যে একটা ওয়াচ্‌টাওয়ার আছে যেখান থেকে বাঘ দেখার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বাঘ দেখতে চাইলেই তো আর বাঘ দেখা যায় না, তার জন্য বিশেষ সৌভাগ্যের প্রয়োজন হয়। একটা কথা মনে রাখতে হবে সুন্দরবনের বাঘ হল ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার’ – এদের আকৃতি সুবিশাল না হলেও চেহারার সৌন্দর্য্যের জন্য এদের খ্যাতি পৃথিবীজোড়া। এদের চালচলনের মধ্যে যে রাজকীয় মেজাজ রয়েছে তার জন্যই এদের এই নাম। আমরা সাধারণ মানুষ, সাধারণ প্রজা – রাজসকাশে গিয়েছি। আমাদের ইচ্ছে থাকলেই যে রাজা আমাদের দেখা দেবেন এমন আশা করাও ঠিক নয়, রাজা নিজের ইচ্ছানুযায়ীই চলাফেরা করবেন। আমরা সুধন্যখালির ওয়াচ্‌টাওয়ার থেকে কিছুক্ষণ গাছের মাথা দেখে নেমে এলাম। ফেরার পথে দেখলাম এক জায়গায় একটা বোর্ড রাখা রয়েছে, সেখানে গত দুমাসের মধ্যে সুধন্যখালিতে কে কবে কখন বাঘ দেখেছে সেগুলো লেখা আছে। এই সময়গুলোর মধ্যে একটা প্যাটার্ন রয়েছে আর সেটা হল সেগুলো সবই বিকেল চারটে থেকে সন্ধ্যে সাড়ে ছটার মধ্যে। আমাদের গাইডের থেকে জেনেছিলাম বাঘ সাধারণতঃ খুব সকাল বা বিকেলের দিকেই দেখা যায় কারণ এই সময়ে ওরা জলের ধারে আসে জল খেতে। ভরদুপুরবেলা বাঘ সাধারণতঃ খেয়েদেয়ে বিশ্রাম করে আর এইসময়ে এদের দেখার আশা করার কোনও মানে হয় না। সুধন্যখালিতেও একইরকম ব্যবস্থা – যেখানে লঞ্চ থেকে নামা সেখান থেকে ওঠা নয়। লঞ্চে উঠে আমরা এগিয়ে চললাম আমাদের দিনের তৃতীয় তথা শেষ গন্তব্য দোবাঁকি-র দিকে। সুধন্যখালি থেকে দোবাঁকি প্রায় ঘন্টা দেড়েক, তাই এইসময়ে আমাদের লাঞ্চ দিয়ে দিল। এদিনের মেনু ভাত, ডাল, আলুভাজা, পারশে মাছের ঝাল, চাটনি, পাঁপড় ইত্যাদি। লাঞ্চ শেষ হতে হতে তিনটের বেশি হয়ে গেল আর আমরা দোবাঁকির কাছে পৌঁছে গেলাম। দোবাঁকির কাছে দত্তা নদী ধরে আরও মোহনার দিকে এগিয়ে গেলে দত্তা নদী যেখানে বিদ্যাধরী নদীর সঙ্গে মেশে, প্রায় সেই জায়গাতেই দোবাঁকি। পাড়ের একেবারে কাছে পৌঁছে একটা ঘটনা ঘটল আর সেটা আমাদের বেশ বড় বিপদের কারণ হতে পারত। আমাদের লঞ্চ চড়ায় কিছুটা আটকে গেল। আমাদের চালক ব্যাপারটা আগে থেকে আন্দাজ করতে পেরেছিল আর সেইভাবে কিছুটা তৈরিও ছিল, তাই আমরা একেবারে আটকে গেলাম না। কোনওভাবে কিছুটা আগুপিছু করে টরে (ঠিক কিভাবে সেটা আমি বলতে পারব না, কারণ আমি লঞ্চ চালাতে জানি না) বেশ মুন্সিয়ানার সঙ্গে সে চড়া থেকে লঞ্চটাকে উদ্ধার করে আনল। আমরা দেখতে পেলাম আমাদের আগে আরও কয়েকটা লঞ্চ এগিয়ে গিয়েছিল আর চড়ার মধ্যে আটকে গেছে। ব্যাপারটার মধ্যে ভয়ের কিছু নেই, কারণ কোনও লঞ্চই অনন্তকাল চড়ায় আটকে থাকে না, জোয়ার এলেই লঞ্চ চড়া থেকে ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু চড়ায় একবার আটকে গেলে জোয়ার আসার আগে উদ্ধার পাওয়ার আশা কম আর সেক্ষেত্রে দোবাঁকি দেখা তো হবেই না উল্টে রাত পর্যন্ত্য অপেক্ষা করতে হতে পারে। তাই এরকম ঘটনা একেবারেই অভিপ্রেত নয়। আমাদের লঞ্চ একটা অন্য জলপথ দিয়ে দোবাঁকির দিকে এগিয়ে চলল। এখানে জলের গভীরতা বেশি তাই আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বেশ কিছুটা ঘুরপথ বলে আমাদের দোবাঁকি পৌঁছতে আরও আধঘন্টা দেরি হয়ে গেল। দোবাঁকিতে আমরা নামলাম তখন দুপুর সাড়ে তিনটে আর দোবাঁকি বিকেল চারটে পর্যন্ত্য খোলা থাকে।দোবাঁকিতে হরিণের জল খাওয়া। এ পর্যন্ত্য যে কটা জায়গা দেখেছি, তার মধ্যে দোবাঁকি আমার সবথেকে বেশি ভালো লাগল। এখানেও একটা ওয়াচ্‌টাওয়ার আছে আর সেখান থেকেই আমরা একটা হরিণের পাল দেখতে পেলাম। বিকেল হয়ে এসেছে, এটা হল বনের জন্তুদের জল খাওয়ার সময়। আমরা সাত-আটটা হরিণকে দেখতে পেলাম জঙ্গলের মধ্যে থেকে বেরিয়ে একটা পায়ে চলা রাস্তা পেরিয়ে একটা জলাশয়ে নেমে জল খেল আবার কিছুক্ষণ পরে জঙ্গলের মধ্যে ফিরে গেল। এটা একটা দূর্দান্ত দৃশ্য আর দেখে আমাদের সত্যিই খুব ভালো লাগল। কাছাকাছির মধ্যে দুটো গোসাপও ছিল, সেটা আমাদের উপরি পাওনা (না, গোসাপ হরিণকে আক্রমণ করেনি, কারণ হরিণ গোসাপের খাদ্য নয়)। ওয়াচ্‌টাওয়ার থেকে নেমে আমরা একটা জাল দিয়ে ঘেরা পথ দিয়ে এগিয়ে চললাম। এটা আসলে একটা ব্রীজ, হেঁটে যাওয়ার জন্য। মাটি থেকে প্রায় পনেরো ফুট উঁচুতে এই পথটা তৈরি করা হয়েছে ট্যুরিস্টদের হাঁটার জন্য। ভাগ্য ভালো থাকলে এখান থেকে বাঘও দেখা যেতে পারে। আমরা অবশ্য বাঘ দেখতে পাইনি, তবে একজায়গায় বাঘের পায়ের ছাপ দেখতে পেয়েছি। ছাপটা টাটকা নয়, বেশ কিছুদিনের পুরনো। তবুও, বাঘের পায়ের ছাপ তো ! সেটাই বা কম কিসের ?

ভ্রমনপিপাসুদের কাছে সুন্দরবন এক মনোরম স্থান, আসুন জেনে নিই সুন্দরমন ভ্রমনের আদ্যোপান্ত - West Bengal News 24

জলের ওপরে সূর্য্যাস্ত – দোবাঁকি থেকে ফেরার সময়ে দোবাঁকি থেকে লঞ্চে উঠে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। আমরা পাখিরালয় থেকে অনেকটা দক্ষিণদিকে চলে এসেছি, তাই ফিরতে অনেকটা সময় লাগবে। আমরা লঞ্চে উঠলাম সোয়া চারটে আর আমাদের গাইড বলল পাখিরালয়ে পৌঁছতে সাতটা বেজে যাবে। লঞ্চে করে সারাদিন ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতাটা নিঃসন্দেহে ভাল কিন্তু দোবাঁকি থেকে পাখিরালয়ে ফেরার এই লঞ্চযাত্রাটা একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমরা যখন লঞ্চে উঠে কিছুটা এগোলাম, তখনই সূর্য্যাস্তের সময় হয়ে গেল। আর এই সূর্য্যাস্তটা আমরা দেখতে পেলাম একেবারে বিদ্যাধরী নদীর উপরে। বিদ্যাধরী খুব চওড়া নদী, জায়গায় জায়গায় এপার-ওপার দেখা যায় না। এইরকম জায়গায় সূর্য্যাস্ত হলে মনে হয় সূর্য্য আসলে জলের মধ্যেই অস্ত যাচ্ছে। সূর্য্যাস্ত হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ আকাশে আলো থাকে আর তারপর একেবারে অন্ধকার। অন্ধকারের একটা নিজস্ব সৌন্দর্য্য আছে এটা আগেও দেখেছি, কিন্তু এইভাবে জলের ওপর লঞ্চে চড়ে সেই সৌন্দর্য্য কখনও উপলব্ধি করিনি। একটু পরে আকাশে চাঁদ উঠল। দুদিন পরেই পূর্ণিমা, তাই চাঁদের আলোর বেশ জোর আছে। এ’এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছিল পাখিরালয়ে পৌঁছতে যতটা দেরি হয় ততই ভালো, তত বেশি করে প্রকৃতির এই রূপসুধা পান করা যায়, তত ভালোভাবে এই সৌন্দর্য্যে অবগাহন করা যায়! (অনুভূতিটা আমার, ভাষাটা ধার করা, কোথা থেকে মনে পড়ছে না, তবে যেখান থেকেই হোক আমি লেখকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি)
সাতটা নাগাদ আমরা পাখিরালয়ে পৌঁছলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সন্ধ্যের জলখাবার চাউমিন দিল। এই একটা জিনিস এরা একেবারেই ভালোভাবে তৈরি করতে পারেনি, জিনিসটা খেতে সেরকম ভালো হয়নি । যাই হোক, এরা বাকি রান্নাগুলোর সবকটাই ভালো করে, তাই এইটুকু মাফ করে দেওয়া হল ।

সন্ধ্যেবেলা ঘরে বসে কিছুই করার থেকে না, তাই আমরা আবারও পাখিরালয় বাজারের দিকে গেলাম। বেড়াতে গেলে কিছু জিনিস কিনতেই হয়, এখানেও বাজারে গিয়ে সেরকম কিছু জিনিস কেনা হল। লজে ফিরলাম তখন প্রায় রাত নটা। দশটা নাগাদ ডিনার দিল। মেনু ছিল ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেন আর দুটো রান্নাই দূর্দান্ত হয়েছিল। খাওয়ানোর ব্যাপারে প্রথমদিন থেকেই এদের মধ্যে কোনও কার্পণ্য দেখিনি, আর সেটা এই চাইনিজ মেনুতেও বজায় রইল। খাওয়ার পরে ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। ২০১৫ সালের শেষ দিন আর আমাদের সুন্দরবন ঘোরারও শেষ দিন। আমরা রেডি হয়ে মালপত্র নিয়ে লঞ্চে উঠে পড়লাম। আমরা আর পাখিরালয়ে ফিরব না, লঞ্চে করে প্রথমে ঝড়খালি যাব আর সেখান থেকে সোনাখালিতে ফিরে যাব। সবকিছু গুছিয়ে লঞ্চ ছাড়ল তখন সকাল নটা। পাখিরালয় থেকে ঝড়খালি যেতে সময় লাগে প্রায় তিনঘন্টা আর এই যাত্রাপথটাও আগেরদিনের মতোই – দারুণ !

লঞ্চ ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে জলখাবার দিল – কচুরি, ছোলার ডাল। যাত্রাপথের বিবরণ আর নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই, আমরা ঝড়খালি পৌঁছলাম তখন দুপুর বারোটা। ঝড়খালিতে বাঘ দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা সবথেকে বেশি কারণ খবরে যে প্রায়ই শোনা যায় সুন্দরবনের বাঘ নদী পেরিয়ে গ্রামে চলে এসেছে, তার অনেকগুলোই ঝড়খালির খবর। ঝড়খালি সুন্দরবনের কোর এরিয়ার (অর্থাৎ যেখানে বাঘ বা অন্যান্য জন্তুদের বাসস্থান এবং তাদের লালনপালন করা হয়) মধ্যে না পড়লেও নদী পেরিয়ে বাঘের পক্ষে এখানে এসে পড়াটা কঠিন নয়। কিন্তু তাই বলে আমি কখনওই চাইনি যে আমরা যখন ঝড়খালির রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, তখন সামনে একটা বাঘ এসে পড়ুক !জেটিতে নেমে আমরা এগিয়ে গেলাম চিড়িয়াখানার দিকে। ঢোকার খরচ পাথাপিছু ৩০/- টাকা। ঝড়খালির চিড়িয়াখানায় বেশ ভালোই ভিড় হয়েছে। দেখে মনে হয় শুধু ট্যুরিস্ট নয়, এখানকার লোক্যাল লোকজনও চিড়িয়াখানা দেখতে এসেছে। আমরা এগিয়ে চললাম বাঘের খাঁচার দিকে। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার চিড়িয়াখানার মধ্যে একটা সুবিশাল জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছে বাঘের খাঁচা। জায়গাটা এতটাই বড় যে বাঘের হয়তো মনেই হবে না যে সে আসলে একটা খাঁচার মধ্যে রয়েছে। অনেক গাছ, হাঁটু পর্যন্ত্য উঁচু ঘাস, জলাশয় – সবমিলিয়ে বাঘের পছন্দের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। আমরা খাঁচার ধার দিয়ে হেঁটে এগোচ্ছি বাঘমামাকে দেখার আশায়। হঠাৎ “দেখা গেছে, দেখা গেছে” আর “খুব কাছে” এইজাতীয় চিৎকার শুনে দৌড়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম আর আমাদের সুন্দরবন যাত্রাকে পুরোপুরি সার্থক করে আমাদের সামনে দেখা দিলেন – শার্দুল সম্রাট ওরফে দক্ষিণরায় ওরফে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার ! (হ্যাঁ, আমরা এইভাবেই বাঘ দেখেছি। আর আমি কখনও দাবিও করিনি যে আমরা হঠাৎ করে জলের ধারে বা অন্য কোথাও বাঘের দেখা পেয়েছি।) আমরা খাঁচার গায়ে একরকম আটকে দাঁড়িয়ে আছি, খাঁচার ওপাশে একটা ফুটদশেক চওড়া পরিখা আর তার ওপাশেই বাঘ ।

রাজসকাশে এত কাছ থেকে এর আগে কখনও রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার দেখিনি, দৃশ্যটা সত্যিই দেখার মতো। বাঘের যে বয়স হয়েছে সেটা তাকে দেখলে বোঝা যায় কিন্তু তার হাঁটাচলার মধ্যে রাজকীয় ভাবটা পুরোমাত্রা বর্তমান। কয়েকমূহুর্ত একজায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে বাঘ আবার হাঁটাচলা শুরু করল। বেশ খানিকক্ষণ আমাদের রাজদর্শন দিয়ে সম্মানিত করে বাঘ আমাদের বিপরীতদিকে চলে গেল। যথেষ্ট দেখা হয়েছে, ক্যামেরায় যথেষ্ট ছবি তোলা হয়েছে, তাই আমরা এবার চিড়িয়াখানা থেকে বেরোবার পথ ধরলাম। ও হ্যাঁ, বাঘের খাঁচার পরিখার মধ্যে কয়েকটা কুমীরও দেখতে পেয়েছি কিন্তু আমি সরীসৃপশ্রেণীর ব্যাপারে খুব কম আগ্রহী, তাই এদের ব্যাপারে আর কিছু উল্লেখ করছি না ।

সুন্দরবন ঘোরা শেষ, বাঘ দেখা সার্থক হয়েছে তাই এবার লঞ্চে উঠে আমরা ফেরার পথ ধরলাম। ঝড়খালি থেকে আমাদের গন্তব্য সোনাখালি যেখানে আমাদের জন্য গাড়ির অপেক্ষা করার কথা। আমরা লঞ্চে উঠলাম তখন দুপুর দেড়টা। ঝড়খালি থেকে সোনাখালিতে পৌঁছতে প্রায় ঘন্টাপাঁচেক লাগবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাঞ্চ দিল। শেষদিনের মেনুটা যাকে বলে বাম্পার। ভাত, ডাল, আলুভাজা আর পোনা মাছের সঙ্গে যোগ হয়েছে বাগদা চিংড়ি মালাইকারী। চিংড়ির সাইজ বেশ বড়র দিকেই আর মালাইকারী যে ব্যাকরণসম্মত না হলেও জিহ্বাসম্মত যে হয়েইছিল, সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। শেষদিনের খাওয়াটা একটু বেশিরকমেরই ভালো হল। লঞ্চের ডেকে বসে বসেই সময় কেটে যায়। দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যে। লঞ্চ সোনাখালি পোঁছল সাড়ে ছটার পরে। মালপত্র নিয়ে লঞ্চ থেকে আমরা গাড়িতে উঠে পড়লাম। গাড়ির ব্যবস্থা একইরকম। বাড়ি ঢুকলাম তখন প্রায় রাত দশটা। সুন্দরবন বেড়ানোর এখানেই শেষ।

আরও পড়ুন ::

Back to top button