কয়েক দিন বাদেই চড়ক, জেনে নিন চড়ক পূজার ইতিবৃত্ত!
কথায় আছে বাঙ্গালীদের বারো মাসে তেরো পার্বণ, কথাটা যে একেবারেই মিথ্যে তা কিন্তু বলা যায় না। বছরের বেশিরভাগ সময়েই কোনো না কোনো উত্সব লেগেই থাকে পশ্চিমবঙ্গে। সম্প্রতি নববর্ষের প্রাক্কালে আর কিছুদিন পরেই শুরু হতে চলেছে চড়ক পুজো। আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা এই পুজো সম্বন্ধে বিস্তারিত জেনে নেব। প্রসঙ্গত চড়ক পুজো হচ্ছে,পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব।চৈত্র মাসের শেষ দিন বা চৈত্র সংক্রান্তিতে পালিত হয় চড়ক পুজো। শিবের গাজন উৎসবের এটি একটি প্রধান অঙ্গ হিসেবে পরিচিত।লিঙ্গপুরাণ, বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে চৈত্র মাসে শিবারাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি উৎসবের উল্লেখ থাকলেও চড়ক পূজার উল্লেখ নেই।তবে এই উৎসব উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় জমজমাট ভাবে মেলা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। এই পুজোর বিস্তারিত কোন ইতিহাস এখনো কোন শাস্ত্রে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে জনশ্রুতি অনুযায়ী প্রচলিত রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পুজোর প্রচলন করেন। রাজ পরিবারের লোকজন এই পুজো আরম্ভ করলেও চড়কপুজো কখনও রাজ-রাজড়াদের পুজো ছিল না। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার এই পুজোয় কোন ব্রাহ্মণ পুরোহিত এর প্রয়োজন পড়ে না।শিবের গাজন এই চড়কপূজারই রকমফের।চড়কপূজার একটি বিশেষ অঙ্গ হিসেবে পরিচিত নীল পুজো।
আরো পড়ুন : এই ৫ বিপজ্জনক ভাইরাস তাণ্ডব চালিয়েছে পুরো বিশ্বে
আসুন এই পুজো সম্বন্ধে কিছু নিয়ম বিধি জেনে নেওয়া যাক! প্রথমেই পূজার আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ বা সিঁদুরমথিত লম্বা কাঠের তক্তা রেখে দেওয়া হয়।যা পূজারিদের কাছে ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। আবার এই পুজোর ক্ষেত্রে কয়েকটি বিশেষ অনুষ্ঠান রয়েছে। যেমন—কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছে দোলা এবং দানো-বারনো বা হাজরা পূজা করা। বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে এই পুজো প্রধানত ভূত প্রেত এবং পুনর্জন্মবাদের প্রতি বিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে করা হয়।পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়।
চড়কগাছে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। যদিও কিছু কিছু জায়গায় সরকারিভাবে নিয়ম করে এই শারীরিক নির্যাতনের অংশগুলির বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।পূজার উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল নিয়ে সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। দলে থাকে একজন শিব ও দুজন সখী।এরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে গাজনের গান গায় এবং নাচ-গান পরিবেশন করে।বাংলা ছাড়াও ভারতের বেশকিছু রাজ্যে আলাদা আলাদা নিয়মাবলীর সংস্পর্শে এই ধরনের বিভিন্ন রকমের অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে।গ্রামীণ লোককথায় বলা হয়, পরম শিবভক্ত বাণরাজা যুদ্ধ করেছিলেন দ্বারকার অধিপতি তথা বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হওয়ার পর অমরত্ব পাওয়ার আশায় তিনি চৈত্র মাসের শেষ দিনে অনুচরদের নিয়ে নাচে গানে আত্মহারা হয়ে নিজের শরীরের রক্ত বের করে সমর্পণ করেন শিবের উদ্দেশ্যে। সেই ঘটনার স্মৃতিতেই প্রত্যেক বছর এই দিনে চড়ক উৎসব পালন করা হয়।তবে এই বছর করোনা মহামারির কারণে এই উৎসব কতটা জনপ্রিয়তা লাভ করবে তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।