অনেকেই নদিয়া জেলার সদর শহর কৃষ্ণনগরে ঘুরতে আসেন। পশ্চিমবঙ্গের পর্যটন মানচিত্রে কৃষ্ণনগর অনেকটাই অবহেলিত, তবুও ভ্রমণ পিপাসু মানুষেরা নিজ নিজ আগ্রহে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি, ঘূর্ণির মাটির পুতুল, বারোদোল মেলা, সরপুরিয়া সরভাজা, জগদ্ধাত্রী পুজো, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জন্মভিটে প্রভৃতির টানে কৃষ্ণনগরে ছুটে আসেন। অনুসন্ধিৎসু পর্যটকেরা আবার এগুলির পাশাপাশি তাদের দ্রষ্টব্য তালিকায় আরও দু-একটি বিষয় সংযোজন করেন। কিন্তু কৃষ্ণনগরের অন্যতম ঐতিহাসিক ভবন ‘কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ’ পর্যটকদের সেই পরিবর্ধিত তালিকাতেও ঠাঁই পায় না। তার খোঁজ কোনো পর্যটকই করেন না। করবেনই বা কেন? স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেই অনেকে এই ভবনের সাথে এখনো পরিচিত নন। ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে চলা কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ তাই এখনো অনেকটাই অনালোচিত।
তবে আমরা কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজের ইতিহাস অনুসন্ধান করতে বসলে অনেক রোমাঞ্চকর তথ্য পাব। কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ মন্দির উদ্বোধনের জন্য স্বয়ং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন। কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় অবদানও ছিল। প্রসঙ্গত বলে রাখি, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুসন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কৃষ্ণনগরে এসেছিলেন এবং চৌধুরী পরিবারের বাসভবনে কয়েকদিন ছিলেন। সেই ভবনটির নাম ‘রানীকুঠি’। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীদের সেই বাড়ি হেরিটেজ তকমা পেলেও, ব্রাহ্মসমাজের মতোই তার ভগ্নপ্রায় অবস্থা দেখে আজ অনেকেরই কান্না পাবে। উল্লেখ্য, ‘কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ’ এবং ‘রানীকুঠি’ এই দুটি জরাজীর্ণ ভবনের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
নদিয়া-রাজ মহারাজা শ্রীশচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষ্ণনগরে প্রথম ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়। প্রথমে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু রাজা মনক্ষুণ্ণ হওয়ায় তিনি ব্রাহ্মগণকে রাজবাড়িতে সমাজ করতে নিষেধ করেন। তখন ব্রাহ্মণগণ আমিন বাজারে একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে ব্রাহ্মসমাজ স্থাপন করেন। ব্রজনাথ মুখোপাধ্যায় কিছুদিনের জন্য উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছিলেন বলে জানা যায়। তার কিছুদিনের মধ্যেই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে একজন বেদবত্তা ব্রাহ্ম উপাচার্য প্রেরণ করেছিলেন। ব্রাহ্মসমাজ স্থাপনের পর কৃষ্ণনগরে ব্রাহ্মধর্মের জনপ্রিয়তা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল।
এই অবস্থায় দেবেন্দ্রনাথের আনুকূল্যে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের বর্তমান ভবনটি নির্মিত হয়। একথা সকলেরই জানা যে, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মধর্ম বিস্তারের ক্ষেত্রে অতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই সূত্র ধরেই এই ভবনটি উদ্বোধনের সময় কৃষ্ণনগরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটে এসেছিলেন। আর এও জানা যায় যে, তিনি কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ নির্মাণের জন্য এক হাজার টাকা প্রদান করেছিলেন। সুদীর্ঘ এক ইতিহাস বহন করে চলা ঐতিহাসিক ভবন ‘কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ’ আজও দণ্ডায়মান। কিন্তু সে আজ জরাজীর্ণ। তার শরীরের শরীরের হাড় পাঁজর সব বার হয়ে গেছে। হবে নাই না কেন? কোনো পরিচর্যাই সে পায় না যে। কৃষ্ণনগর ব্রাহ্মসমাজ ইতিপূর্বে ‘হেরিটেজ ভবন’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। তবুও এই ভবনের এহেন করুণ দশা— যা সত্যিই ভাবায়! এর জন্য দায়ী কে?
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।