জীবন যাত্রা

স্ত্রীর প্রতি অহেতুক রেগে যান ৪৭ শতাংশ স্বামী

স্ত্রীর প্রতি অহেতুক রেগে যান ৪৭ শতাংশ স্বামী

‘পান থেকে চুন খঁসলেই’ স্ত্রীর দোষ-ত্রুটি ধরে রাগারাগি করা আবহমান কাল ধরেই চলে আসা গ্রাম বাংলার চিরচেনা ব্যবস্থার একটি দিক। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এ যুগেও সমাজের চিরন্তন সে ‘আচারে’র খুব একটা পরিবর্তন ঘটেনি। এমনকি,আধুনিক শহুরে সমাজেও স্ত্রীর সামান্য ভুলেও বকাঝকা খেতে হয় স্বামীর কাছে।

হোক কারণ বা অকারণে,শিক্ষিত শহুরে সমাজ বা শহরের আঁচ পেতে শুরু করা গ্রামীণ সমাজ। সবখানেই প্রায়ই স্ত্রীদের প্রতি অকারণে রেগে যাওয়া স্বামীদের খোঁজ মিলবে হরহামেশাই।

এবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপেও উঠে এলো অহেতুক স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের ক্রুব্ধ হয়ে ওঠার বিষয়টি।

বিবিএসের সর্বশেষ ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে ২০১৫’ শীর্ষক দ্বিতীয় জরিপে উঠে এসেছে দেশের ৪৭ শতাংশ বিবাহিত নারীর স্বামীই অকারণে স্ত্রীদের প্রতি রেগে ওঠেন। সম্প্রতি এ জরিপ প্রকাশিত হয়েছে।

বিবাহিত নারীদের শারীরিক নির্যাতন বলতে মূলত স্বামীর হাতে নির্যাতন বোঝানো হলেও, স্বামীদের এ ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণও নির্যাতন। এমনকি, মোট নারী নির্যাতনের মধ্যে বিবাহিত নারীর ১৫ শতাংশই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার।

এটাই উঠে এসেছে বিবিএসের এই জরিপে। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জরিপটি চালাতে বিবিএসকে সহায়তা করেছে।

মাঠপর্যায়ে গত বছরের ১৩ থেকে ২২ আগস্ট পর্যন্ত জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। দেশের সাতটি বিভাগীয় শহর, গ্রাম, সিটি করপোরেশন ও সিটি করপোরেশনের বাইরের শহরকে জরিপের আওতায় আনা হয়েছে। শারীরিক, যৌন, অর্থনৈতিক, স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাবের কারণে এবং আবেগীয় নির্যাতনকে জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। জরিপের জন্য ১৫ বছরের বেশি বয়সী মোট ২১ হাজার ৬৮৮ জন নারীর সঙ্গে কথা বলেছেন মাঠকর্মীরা। তবে এদের মধ্যে অবিবাহিত নারী ছিলেন ১ হাজার ৭০১ জন।

জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণসংক্রান্ত নির্যাতনের মধ্যে স্বামীর অকারণে রেগে যাওয়ার হার বেশি। বিবাহিত ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারীরা অকারণে স্বামী রেগে যাওয়ায় নির্যাতনের শিকার হন।

একই জরিপে স্বামীদের এ ধরনের আচরণের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক ছিল, স্ত্রী স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য স্বামীর অনুমতি নেবেন এটা চান স্বামী। বিবাহিত জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে এ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় অন্তত ৩৬ শতাংশ নারীকে।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী,বিবাহিত নারীদের ৮০ দশমিক ২ শতাংশ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে স্বামীর হাতে কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হন।

এই জরিপে দেশের বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা রেখে স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের একটি সংজ্ঞাও খোঁজা হয়েছে। জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুযায়ী এ জরিপে নারীদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ করতে স্বামী বাধা দেন কি না; বাবার বাড়ি যেতে দেন কি না; স্ত্রী কোথায়, কীভাবে থাকেন ও সময় কাটান তা সন্দেহজনকভাবে জানতে চান কি না; ভালো-মন্দকে গুরুত্ব না দিয়ে অগ্রাহ্য করেন কি না; আত্মীয় বা অনাত্মীয় পুরুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে স্বামী রেগে যান কি না; স্বামী প্রায়ই কোনো না কোনো কারণে সন্দেহ বা অবিশ্বাস করেন কি না এবং স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার আগে স্বামীর অনুমতি নিতে হয় কি না।

এছাড়া দেশীয় প্রেক্ষাপটে জানতে চাওয়া হয়, পোশাক নিয়ে স্বামী বিধিনিষেধ আরোপ করেন কি না; পড়াশোনা বা চাকরি করতে বাধা দেন কি না; বাইরে বেড়াতে যেতে বাধা দেন কি না; মা-বাবা সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য বা তাঁদের গালাগাল ও অসম্মান করে কথা বলেন কি না; জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া গ্রহণে বাধ্য করেন কি না বা পদ্ধতি গ্রহণে বাধা দেন কি না; কন্যাসন্তান প্রসবের কারণে খারাপ আচরণ করেন কি না; ননদ-দেবরসহ পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের নালিশের কারণে খারাপ আচরণ করেন কি না; কোনো কারণ ছাড়াই রেগে যান কি না।

জরিপে বলা হয়েছে, কোনো না কোনো সময়ে এসব প্রশ্নের অন্তত এক বা একাধিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে ৭০ দশমিক ৯ শতাংশ নারীকে।

এতে দেখানো হয়েছে,৬০ বছর ও তার বেশি বয়সী নারীদের ৫৮ শতাংশ এবং ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক নির্যাতনের শিকার বেশি হন। তবে গত ১২ মাসের হিসাবে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারীদের প্রায় ৪৪ শতাংশ ও ৫৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সী নারীদের ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

জরিপে আরও বলা হয়েছে, স্বামীর নির্যাতনের পেছনে শিক্ষারও প্রভাব রয়েছে। অশিক্ষিত নারীদের ৫৬ শতাংশের বেশি এ ধরনের নির্যাতনের শিকার। গত ১২ মাসের হিসাবে এ হার ৩৯ শতাংশের বেশি। এছাড়া ডিগ্রি বা তার থেকেও বেশি শিক্ষিত নারীরা নির্যাতনের শিকার ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে দরিদ্র ও গ্রামীণ নারীদেরর ক্ষেত্রে নির্যাতনের হার আরও বেশি।

এদিকে, নির্যাতনের শিকার অন্তত ৭২ দশমিক ৭ শতাংশ নারী কখনই নির্যাতনের কথা কাউকে জানাননি। এদের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ নারী পুলিশের সহায়তা চেয়েছেন। পারিবারিক সম্মান, স্বামীর নির্যাতনের অধিকার ও লোকলজ্জার ভয়ে নির্যাতনের কথা কাউকে জানাতে পারেননি বলে জানিয়েছেন ৩৯ শতাংশ নারী।

আরও পড়ুন ::

Back to top button