ঝাড়গ্রাম

লোক যাত্রাপালার শেষ শিল্পী মদন বেরার দিন কাটছে অপ্রাপ্তির হতাশায়

স্বপ্নীল মজুমদার

লোক যাত্রাপালার শেষ শিল্পী মদন বেরার দিন কাটছে অপ্রাপ্তির হতাশায়
লোকপালা শিল্পী মদন বেরা

৮১ বছরের মদন বেরা। নিরক্ষর। কোনও দিন স্কুলে যাননি। অথচ ঝাড়গ্রাম জেলার সুবর্ণরৈখিক এলাকার ওড়িয়া মিশ্রিত প্রাচীন লোকপালা ‘চড়িয়া চড়িয়ানি’ ও ‘ললিতা শবর’ তাঁর কন্ঠস্থ। শ্রুতিনির্ভর এই লোকপালাগুলি প্রজন্মান্তরে মুখে মুখে অভিনীত হয়েছে। মদনই এখন শেষ পালা-কথক। তিনি ‘মাস্টার’। শিখিয়েছেন দলের সদস্যদের। সদস্যরাও কেউ পঞ্চাশোর্ধ্ব, কেউ বা ষাটের কোঠায়। নতুন প্রজন্মের কেউই আর পালাগানে আগ্রহী নন। ঝাড়গ্রাম জেলার সাঁকরাইল ব্লকের ভগবানচক গ্রামে মদনের বাড়ি। প্রয়াত লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় কয়েক বছর আগে লোকপ্রসার প্রকল্পে মদন ও তাঁর ‘মা দুর্গা অপেরা’র শিল্পী-য‌ন্ত্রীদের নাম উঠেছে।

কিন্তু বর্ষীয়ান মদ‌ন আজ পর্যন্ত কোনও সম্মান স্বীকৃতি পাননি। সুবর্ণরৈখিক লোকপালাগুলির সংরক্ষণের জন্যও সরকারি স্তরে কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মদন অবশ্য বলছেন, ‘‘পৃথিবীতে কিছুই চিরস্থায়ী নয়। কত গাছ, প্রাণি, পাখির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গিয়েছে। নদীর পাড় ভেঙে হারিয়ে গিয়েছে কত জনপদ। আমার মৃত্যু হলে এই লোকপালার ধারাও হারিয়ে যাবে। তাতে কারও কিছু আসবে যাবে না।’’ অভিমানের সুর ঝরে পড়ল তাঁর গলায়। তিনি বলছেন, ‘‘এক সময়ে লোকপালার আসরে ভিড় উপচে পড়ত। আর এখন সরকারি অনুষ্ঠান ছাড়া আগের মতো মেলা-পার্বণে ডাক আসে না। করোনা আবহে তো সরকারি অনুষ্ঠানেও ডাক আসা বন্ধ। অসুস্থ শরীরে এখন আর অনুষ্ঠানও করতে পারেন না তিনি।

লোক যাত্রাপালার শেষ শিল্পী মদন বেরার দিন কাটছে অপ্রাপ্তির হতাশায়

মদনের জন্ম বাংলার ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে তৎকালীন মেদিনীপুরের সাঁকরাইল ব্লকের ভগবানচক গ্রামে। বাবা রাজেন্দ্র বেরা ছিলেন প্রান্তিক চাষি। মা দুখো বেরার সংসার যেন বারো মাসই অভাবের দুঃখে ভরা ছিল। রাজেন্দ্র-দুখোর দুই সন্তান। মদন ও তাঁর ছোট বোন চেনো বেরা। মদনের যখন পাঁচ বছর বয়স তখন দুরারোগ্য অসুখে তাঁর বাবা রাজেন্দ্রর মৃত্যু হয়। ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে কুকড়াখুপি গ্রামে ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন দুখো। মামার বাড়িতে থাকাকালীন মদন গরু চরাতেন। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। মামা বলতেন, অভাবের সংসারে পড়াশোনা তো বিলাসিতা। খেটে খেতে হবে। চাষবাস আর দিনমজুরি অদৃষ্টে লেখা রয়েছে। মামাও চাষাবাদ করতেন। বয়স ষোলো হতেই লাঙল কাঁধে মামার জমিতে চাষ করার ভার পড়ল মদনের। মামা জমিতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। মামার উদ্যোগে বোনের বিয়ে হয়ে গেল। ভগবানচকে কিছু চাষ জমি ছিল মদনদের। ১৮ বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে গ্রামে ফিরে এলেন মদন। নিজের জমিতে চাষ করতে শুরু করলেন। মদনের বয়স যখন কুড়ি, তখন তাঁর মা দুখো অসুস্থ হয়ে পড়লেন। রান্না করে খাওয়াবে কে? জেঠু সুরেন্দ্র আর জেঠিমা ফুলো মিলে পাত্রী পছন্দ করলেন আস্তি গ্রামের খুকু বেরাকে। সংসারের হাল ধরলেন সহধর্মিণী খুকু।

ছোট বেলা থেকেই পালাগানের চর্চা ছিল পরিবারে। বড় জেঠু গিরীন্দ্রর ছেলে মদনের জেঠুতো দাদা দাদা গুহিনো বেরা পালাগান করতেন। কাকা সতীশও লোকপালায় নেচে গেয়ে অভিনয় করতেন। বাড়ির উঠোনে দাদা-কাকার মহড়া দেখতেন মদন। তবে একবার বনপুরা গ্রামের মেলায় ‘চড়িয়া চড়িয়ানি’ দেখে মুগ্ধ হলেন। শুনে-শুনেই শিখে নিলেন দু’টি পালা। কাকা সতীশের মৃত্যুর পরে পালাগানের দলে মদনকে ডেকে নিলেন দাদা গুহিনো। আর পরে গুহিনোর মৃত্যুর পরে নিজেই লোকপালার ‘মাস্টার’ হয়ে গেলেন মদন। মদ‌ন ,জানালেন, এর তো কোনও লিখিত রূপ নেই। সবটুকুই শ্রুতি নির্ভর।

এখন অবশ্য দলের সদস্যরা খাতায় হাতে লিখে রাখেন পালা। মদনের কথায, “কিন্তু আমি তো পড়তে লিখতে পারি না। স্মৃতি থেকেই সবই পর পর সব সুর করে বলি, গান করি। নাচের মুদ্রা, চোখের ভাষা পায়ের তালের ছন্দ সবই তো মনে রাখা। কোনওটারই লিখিত রূপ সেভাবে তো নেই।” মদন জানান, ঝাড়গ্রামের লোকশিল্প ও সংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের জন্মস্থান কুকড়াখুপি। সেই কারণে সুব্রতবাবুর সঙ্গে পরিচয় বহুদিনের। রাজ্যে নতুন সরকার আসার পরে লোকপ্রসার প্রকল্পে লোকশিল্পীদের কিছুটা সম্মানপ্রাপ্তি হয়েছে। সুব্রত মুখোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়ে তাঁর ও দলের সহশিল্পীদের নাম প্রকল্পে তুলিয়ে দিয়েছিলেন। লোকপালা দলের সদস্যদের বেশির ভাগই মদ‌নের পরিজন। গুহিনোর ছেলে মদনের ভাইপো গদাধর বেরা, কাকা সতীশের ছেলে খুড়তুতো ভাই সুশীল বেরা দলে আছেন। চড়িয়া ও চড়িয়ানি পালায় চড়িয়া সাজেন মদনের খুড়তুতো ভাই কাঙালি। চড়িয়ানি সাজেন ভাইপো গদাধর। মদন সূত্রধর বা ওঝার ভূমিকায় থাকেন। হারমোনিয়াম, খঞ্জনি, বাঁশি, পাখোয়াজ বাজানো হয় পালায়। চড়িয়া চড়িয়ানিতে সব মিলিয়ে ছ’সাতজন শিল্পী ও যন্ত্রী। এই লোকপালাটি রূপকধর্মী। চড়িয়া বারো বছর নিরুদ্দেশ। চড়িয়ানি ওঝাকে বলছে, চড়িয়াকে খুঁজে এনে দিতে। কিন্তু ওঝা খুঁজবে কিভাবে চড়িয়াকে? চড়িয়ার রূপ বর্ণনায় চড়িয়ানির কি বলছে, সেই গানটি শোনালেন মদন। সঙ্গে সুর মেলালেন সুশীল ও গদাধর। ‘‘তিনি ভেঙিয়া টেরি, কথা কহুছনটি আঁখি ঠারি, অলপতানি নিশ। সবু বলে খানতি পান, গলারে পহড়া, সঙ্গে ফুল মালা, কর্ণে সুবর্ণ কুণ্ডল।’’

ললিতা শবর লোকপালাটি একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকের। পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কিভাবে কালো ঠাকুর অর্থাৎ জগন্নাথদেবকে পেয়েছিলেন সেই কাহিনীর মধ্যে অবশ্য ব্রাহ্মণ সন্তান বিদ্যাপতি ও শবর কন্যা ললিতার ব্যর্থপ্রেমের কাহিনী, জাতপাতের সংঘাতের কথাই রয়েছে। জগন্নাথ কেন্দ্রিক ঘটনা ললিতা বিদ্যাপতি প্রেম। ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি ও শবর কন্যা ললিতার ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। ললিতার একটি গান শোনালেন মদন। যেখানে বিদ্যাপতিকে বিদায়বেলায় ললিতা বলছে, ‘‘এথু অনন্তরে শুন সভাজন, স্বামীর পদ ধরি কাঁদই অপারো কেমন্তে ছাড়িবে গো স্বামীর মোহাস।’’

মদন জানালেন, আগে আরও লোকপালা হত। সেগুলো হারিয়ে গিয়েছে। ‘রূপবান’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘কমলেকামিনী’, ‘বাগাম্বর’। লিখিত রূপ না থাকায় আর সেগুলি করার মতো কেউ নেই। মদনও সেই সব লোকপালার চর্চা না করায় এগুলি তাঁর স্মৃতিতে নেই। তবে তিনি জানালেন, বহু আগে ওই সব লোকপালায় পালায় মহিলারা অভিনয় করতেন। সেজন্য বাইরে থেকে নটীদের বায়না করে আনা হত। পরবর্তী কালে মহিলা শিল্পীদের অভাবে সেই পালাগুলির চর্চা বন্ধ হয়ে যায়। এক সময়ে দাপটের সঙ্গে জেলার বিভিন্ন গ্রামীণ উৎসবে, পার্বণে, অনুষ্ঠান বাড়িতে পালাগান করতে দল নিয়ে যেতেন মদন।

একসময় দশ-বিশ-পঞ্চাশ টাকায় পালাগান করতেন। এখন খরচ বেড়েছে। দলের সদস্যরা নিজেরাই খরচ জোগান। পোষাকের খরচ রয়েছে। বাদ্যযন্ত্রগুলি রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের খরচ রয়েছে। এখন হাজার দশেক টাকায় বায়না হয় কালেভদ্রে। মদনের আক্ষেপ, নতুন যুগের ছেলেরা এসব দেখতে-শুনতে চায় না। তাই ডাকও আসে না। ওই সরকারি অনুষ্ঠানে যতটুকু যা হয়। সেই টাকাও যথেষ্ট নয়। কলকাতায় অনুষ্ঠানে গিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতাও হয়েছে। ২০১৫ সালে কলকাতার মোহরকুঞ্জে একটি বেসকারি সংস্থার আয়োজনে জঙ্গলমহল উৎসবের মঞ্চে উঠেও নেমে যেতে হয়েছিল মদন ও সহশিল্পীদের। মদন জানালেন, কলকাতার শিল্পীরা অনুষ্ঠান করবেন, তাই মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে মাঝপথে আমাদের মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা। ভাবুন নাম দেওয়া হয়েছিল জঙ্গলমহল উৎসব, আর জঙ্গলমহলের শিল্পীই সেখানে ব্রাত্য!

তবে ভাল অভিজ্ঞতাও রয়েছে। ঝাড়গ্রাম মেলা যুব উৎসবের মঞ্চে আধঘন্টা বরাদ্দ ছিল ললিতা শবর লোকপালার জন্য। পরে দর্শকদের অনুরোধে আরও এক ঘন্টা অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। পরে কলকাতা আর দুর্গাপুরে অনুষ্ঠানের সুযোগ হয়েছিল।

লোকপ্রসার প্রকল্পে নাম রয়েছে দলের সব শিল্পীর। কিন্তু সরকারি জঙ্গলমহল উৎসবে ডাক পাননি কখনও। অভিমান ঝরে পড়ল শিল্পীর গলায়। এখন সপ্তাহে ছ’দিন সহশিল্পীদের নিয়ে মহড়া দেন। কীর্তনের দল খুলেছেন। কীর্তনের দলটি বিভিন্ন উৎসব পার্বণে ডাক পায়। মদন জানালেন, নতুন প্রজন্মের কেউই লোকপালা শিখতে চান না। তাঁর পরে লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের এই সম্পদ টিকিয়ে রাখার উপায় তিনি দেখছেন না! মদন বলছেন, প্রাচীন বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল লোকপালা। এখন বিনোদনের ধরণ বদলেছে। সাধারণ যাত্রাও অনেকটা আধুনিক সিনেমাধর্মী চটুল আঙ্গিকের হয়েছে। মানুষের মন বদলেছে। সমাজ বদলাচ্ছে। বদলে গিয়েছে নতুন প্রজন্মের মানসিকতা। তাই লোকপালার এই ধারা রপ্ত করার কারও আগ্রহ আর নেই।

মদনের ছেলে মন্টু কিংবা দলের অন্য প্রবীণ শিল্পীদের সন্তানরাও কেউই লোকপালা শেখেননি। শিখতেও চান না। ঝন্টু বলছেন, ‘‘কি হবে শিখে, কেউ তো আর এখন এ সবের কদর করে না। প্রাচীন লোকশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে গিয়ে ঢাকের দায়ে মনসা বিক্রি করতে পারব না।’’
সুবর্ণ রৈখিক লোকপালার শেষ প্রবীণতম শিল্পী মদন বলছেন, ‘‘একদিন হারিয়ে যাবে চড়িয়া চড়িয়ানি, ললিতা শবর। ইতিহাসে নামটুকু থাকবে সে আশাও করি না।’’

আরও পড়ুন ::

Back to top button