জীবন যাত্রা

এত বিরক্ত লাগে

এত বিরক্ত লাগে

সংসার শুরু করেছেন? শুরু হলে তা কেমন চলছে? বোঝাপড়া কেমন? দুজনের চলাফেরা, আচার-আচরণ মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? প্রত্যেকেরই দোষ-গুণ থাকে। আর এই দোষ-গুণ নিয়ে চলতে হয় জীবনভর। কাউকে বিরক্ত করা খুবই সহজ। কিন্তু সঙ্গীর মন জুগিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে আমরা কখনো কেউ ভাবি না। টানাপোড়েনের চেয়ে যে সমঝোতা ভালো, সেটা আমলে নিতে চাই না।

‘খিটিমিটি লেগে আছে। সংসার শুরু করেছি কম তো সময় হলো না। কিন্তু এখনো ওর কিছু কিছু আচরণ আমি মন থেকে মেনে নিতে পারছি না। অতিষ্ঠ আমি। ভালো লাগছে না এই সংসার। প্রেমের সংসার এখন ঘৃণার যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ স্ত্রীর এই ক্ষোভের কথা শুনে সঙ্গে আসা স্বামী বেচারা একটু সংকোচের মধ্যে পড়লেন। স্বামীর চাওয়া হলো বেশি সাজগোজ করা যাবে না। শাড়ি পরলে যেন কোনোভাবেই পেট দেখা না যায়। বেড়াতে গেলে বা বাইরে বের হলে সব সময় স্বামীর শ্যেনদৃষ্টি। আর সহ্য হয় না স্ত্রীর। অনেক সময় বিয়ে, জন্মদিন, সাধারণ কোনো অনুষ্ঠানেও যেতে দেন না স্বামী। উপহার পাঠিয়ে দেন। চোখে চোখে রাখেন বউকে। ভাবখানা, এমনটা না করলে অন্যের সঙ্গে পালিয়ে যেতে পারেন মেয়েটি। মনোজগতের কী ভয়ংকর মুশকিল। অথচ বউটির এমন কোনো কাণ্ড করার আশঙ্কাই নেই। কিন্তু স্বামীর বাতিক যাচ্ছেই না।

আরেক দম্পতি। স্ত্রীর অভিযোগ হলো, ‘আমাকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ আট-দশজন অতিথি নিয়ে এল ভরদুপুরে। দুই-তিনজনের রান্না যা নিয়মিত করি তা-ই করা ছিল বাসায়। হঠাৎ এই উটকো ঝামেলা একদম পছন্দ না। নেমতন্ন করতে আমারও ভালো লাগে। বিভিন্ন পদের রান্না করা শখ। তাই বলে হুটহাট লোকজন নিয়ে বাসায় চলে আসবে এ কেমন কথা?’

আরেক ধরনের অভিযোগ শোনা গেল। ‘সব সময় এ রকম বদমেজাজ ভালো লাগে না। সব সময় রান্না তো এক রকম হয় না। মাঝেমধ্যে স্বাদ ভালো হয় না, তা আমিও বুঝি। বাচ্চাদের পরীক্ষার ফল প্রতিবার কি আমরা যে রকম চাই সে রকম হয়? ওর ব্যবসায়ে আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসান প্রতি মাসে কি একই রকম থাকে? সংসারের খুঁটিনাটি ঝামেলা, সমস্যা, টুকটাক খরচ আমিই তো সামলাই। তাই বলে আমি কি ওর সঙ্গে একটু উনিশ-বিশ হলে বকাঝকা করি?’ বলেন স্বামীর ব্যবহারে অতিষ্ঠ এক নারী।

কেন করেন?
প্রত্যেক মানুষই বেড়ে ওঠেন ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে। কেউ ছোট আকারের পরিবারে, আবার কেউ যৌথ পরিবারে। কেউ মিশুক হয়; আবার কেউ অন্তর্মুখী। কারও পরিবার হয় রক্ষণশীল, আবার কেউ বেড়ে উঠেছেন উদারপন্থী আধুনিক পরিবেশে। বৈবাহিক বন্ধনে কার জোড়া কোথায় আছে আমরা তা জানি না।

আসলে জেনেটিক, পারিবারিক, সামাজিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে একেকজন মানুষ একেক রকম হন। প্রত্যেকের আচার-আচরণ, ব্যবহার, সহ্য করার ক্ষমতা, আবেগ-রাগ-অনুরাগ-বিরাগের ধরন, বহিঃপ্রকাশ—সবই নির্ধারিত হয় কম বয়সেই। ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা দুজনকে একসঙ্গে একই ছাদের নিচে একত্র করে দেওয়ার সামাজিক প্রথারই আরেক নাম হচ্ছে বিয়ে। সুন্দর সংসার নির্বাহ, মিলেমিশে থাকা, ভালোবাসা-সম্প্রীতি-বোঝাপড়া স্বামী-স্ত্রীকেই মিটিয়ে নিতে হয়।
তাহলে কী করা যায়?

সংসারে খটরমটর লাগবে না, তা হয় না। সমস্যা যখন সহ্যের সীমানা অতিক্রম করে তখন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। নিজেকে সামলাতে হবে সমস্যা তীব্র হওয়ার আগেই। অন্য শারীরিক রোগব্যাধির প্রকাশ ঘটে ব্যথা-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। সংসারের সমস্যার প্রকাশ ঘটে নানা খুনসুটি—হয়তো কেউ কেউ খুব চোটপাটের রোগ-রাগ-বিরক্তি ছাড়া নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারেন না। কেউ তিলকে তাল করেন। অল্পতেই এমন প্রতিক্রিয়া করেন যেন বিশ্বসংসারে মহাগোলযোগ লেগে গেছে। এমনটি যাঁদের রোগ, নিজেরা তা ধরতে পারেন না। ভাবেন, তিনি যা করছেন একদম ঠিক করছেন।

যাঁর সমস্যা তিনি যদি বুঝতেন, তবে বিশ্বসংসারে আজ এই কাটাকাটি-হানাহানি থাকত না। সমস্যা দেখামাত্র এমএস ওয়ার্ডের নতুন নতুন ভার্সনের মতো নতুন করে নেওয়ার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। কিন্তু মানুষের মনের ভার্সন কি বদলানো সম্ভব? তবে তিনি যদি অভ্যাস বা তাঁর চিহ্নিত সমস্যাগুলোকে মেনে নিয়ে পরিবর্তিত হওয়ার চেষ্টা করেন, তবে তাঁর পাশে দাঁড়ানো সংসারের অন্যদের কর্তব্য। একে অন্যের পাশে দাঁড়ানো; দুঃখ-সুখ-সমস্যার জ্বালা ভাগ করে নেওয়াই তো সংসারধর্মের দায়।

সমস্যাকারীকে আগে মানতে হবে যে তাঁর কারণেই পরিবারে অশান্তির ঘনঘটা। সুখ-শান্তি¯ নষ্ট হচ্ছে। তবে এই সময় নিজে সমাধানের চেষ্টা না করে অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা এঁদের মধ্যে লক্ষ করা যায়। সময় নিন। নিজেকে বোঝার চেষ্টা করুন। কেন, কোন সময়, কী কারণে এমন আচরণগুলো আপনি করেন তা নিজেকে জিজ্ঞেস করুন। সমস্যার সমাধান আপনিই করতে পারবেন।

একইভাবে আপনার সংসারের সঙ্গী যখন নানা সমস্যা করছেন, তাঁকে শুরুতেই একদম বাতিল করে দেবেন না। তাঁকে বোঝার চেষ্টা করুন। বোঝানোর চেষ্টা করুন। তিনি যে তাঁর সমস্যাগুলো বুঝতে পারছেন না, সেটা বোঝার জন্য সময় দিন। তাঁকে কৌশলে বোঝান। যদি একা বোঝাতে না পারেন বিশ্বস্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়ে বোঝান।

আর ভুক্তভোগী সঙ্গী এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা যা দিনরাত জপ করে চলেছেন, এভাবে আর সম্ভব না। না, এটা করবেন না। বরং সমাধান খুঁজুন। সমাধান আছে। কোনো কিছুই অসাধ্য নয়। কারও দোষত্রুটি নিয়ে সারাক্ষণ লেগে থাকাটা কখনোই কাম্য হতে পারে না। এতে হিতে বিপরীত হবে। সমস্যাকারীর সদিচ্ছা থাকলেও সেটা মানিয়ে নিতে তাঁর কষ্ট হবে। সবার উচিত তাঁকে বোঝার। তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করা। নিজে অনুধাবন-উপলব্ধির চেষ্টা করা। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করা। সংসার তো কোনো কুরুক্ষেত্র নয়। সংসার হলো মিলবার, মেলাবার, মিলনেবর ক্ষেত্র। সংসার হলো মেলবন্ধন।

আরও পড়ুন ::

Back to top button