স্রষ্টার সৃষ্টি কে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেউ রোধ করতে পারিনি। এ জগতে সবকিছু তাঁর সৃষ্টি। আদি অনন্তকাল হইতে এবং মালিক তিনি, তার ইশারাতেই চালিত হয় বিশ্ব সমস্ত জাতি। যে যা ধর্ম আমরা বিশ্বাস করি না কেন ,সবই আরদ্ধা দেবদেবী একমাত্র সৃষ্টি, এ জগত!এই জগতে যে যেখানে বাঙালিরা থাকে ,আজকের দিন সবাই যেন মেতে ওঠে বাংলার ঘরে ঘরে।
নিজের মেয়েকে আমন্ত্রণ করে ঘরে আনে, দুর্গা রূপে। দেবীদুর্গা সপরিবারে মর্তধামে বাপের বাড়িতে প্রবেশ করবেন। তাই আজকের সারা বিশ্বজুড়ে নবপত্রিকা পূজা ও দেবীপক্ষের আমন্ত্রণ।করোনাভাইরাস এর ফলে বাঙ্গালীদের পূজার অনেক বিধি নিষেধ করে দিয়েছে, শুধু মানুষের স্বার্থের জন্য।
তবুও বাঙালি মনের আবেগ, আকাঙ্ক্ষা ও মায়ের ঘরের মেয়েকে ভালোবাসার একটু অশ্রদ্ধা কমেনি এতে।বিশ্বের সমস্ত মা জাতি আজ তার নিজের মেয়েকে দেবী দুর্গা রূপে স্মরণ করে নিজের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাবে। সেই ধর্মীয় উৎসবকে ঘিরে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে আনন্দ ও উৎসাহ-উদ্দীপনা। উৎসবের প্রথম দিনে গতকাল ষষ্ঠীতিথিতে মণ্ডপে মণ্ডপে দেবীর অধিষ্ঠান হয়।
সকালে ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভ এবং বেলতলা কিংবা বেল গাছের নিচে দেয়া হয় ষষ্ঠী পূজা। দেবীর বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা।ঢাকের বাদ্য, শঙ্খ আর উলুধ্বনির শব্দ দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমনের জানান দিচ্ছে। পূজার মন্ত্রোচ্চারণ, আরতি আর মাইকের আওয়াজে এখন মাতোয়ারা সারা দেশের পূজামণ্ডপগুলো।
তবেই প্রতিটি পূজামণ্ডপে ধূপধুনো, বেল-তুলসী, আসন, বস্ত্র, নৈবেদ্য, পুষ্পমাল্য, চন্দনসহ ১৬টি উপাচার দিয়ে দেবী দুর্গাকে আজ পূজা করা হবে। ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার চক্ষুদান করা হবে। আজ মহাসপ্তমী, এই মহাসপ্তমীর সকালে সর্বপ্রথম চক্ষুদানের মধ্যদিয়ে ত্রিনয়নী দেবী দুর্গার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। হিন্দু পুরাণ মতে, মহাসপ্তমীতে ভক্তদের কল্যাণ ও শান্তির আশীর্বাদ নিয়ে হিমালয় নন্দিনী দেবী দুর্গা পূজার পিঁড়িতে বসবেন।
আরও পড়ুন: শারদ উৎসবে মেতে ওঠে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মানুষ
আজ শারদীয় দেবী দুর্গার নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন করা হবে। এরপর সপ্তম্যাদি কল্পারম্ভ ও মহাসপ্তমী বিহিত পূজা অনুষ্ঠিত হবে। দেহ শুদ্ধি, অঙ্গ শুদ্ধি সেরে শুরু হয় পূজা-অর্চনা। ঢাকঢোল, শঙ্খ ধ্বনি-উলু ধ্বনি, খোল-কাসাসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যবাজনা বেজে উঠবে। তা নিয়ে কতই না প্রস্তুতি, সাজগোজ। টানা এক বছর পর ফের বাপের বাড়িতে ফিরলেন মা উমা।
দেবীকে স্বাগত জানানোর কোনও সুযোগই ছাড়তে রাজি নন আম বাঙালি। মস্ত বড় প্যান্ডেল, প্রতিমা নিয়ে জাঁক তো আছেই, রীতি মেনে দুর্গা পুজোর প্রতিটি নিয়ম বা আচার অনুষ্ঠান নিখুঁত ভাবে করার ক্ষেত্রেও বাঙালির জুরি মেলা ভার।তবে ঘরের মেয়েকে মহামায়া শক্তিরূপে আমরা পুজো করি।দেবী দুর্গা মানে মহাশক্তি, মহামায়া, দেবী দুর্গা মানে মাতৃরূপী, শক্তিরূপী, বিপদতারিণী স্নেহময়ী জননী।
দুর্গা নামে সবাই চিনি, দশ হাতধারী মোহময়ী এক নারী মূর্তি, যিনি প্রতি বছর শরৎকালে পুত্র-কন্যা নিয়ে স্বামীর বাড়ি স্বর্গলোক থেকে বাবার বাড়ি মর্ত্যলোকে আসেন এবং তিনি বাংলা মুলুকেই আসেন। আমরা অনেকেই জানি না, দেবী দুর্গা শুধু শরৎকালেই মর্ত্যলোকে আসেন না, শুধু বাংলা মুলুকেই আসেন না, ভক্তের ডাকে দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকের যে কোনো স্থানে নানারূপে আবিভর্‚ত হন।
দুর্গা মায়ের চিরায়ত দশভুজা রূপ ছাড়াও মায়ের আরও নয়টি রূপ আছে, যখন যেরূপে আবিভর্‚ত হওয়া দরকার, দেবী দুর্গা সেরূপেই আবিভর্‚ত হয়ে থাকেন। দেবী দুর্গার নয়টি রূপের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় নেই। সব রূপেই দেবী মহাশক্তির আধার, প্রতি রূপেই দেবী মাতৃরূপা, কল্যাণময়ী, অশুভ শক্তি বিনাশিনী দেবীর অনেক রূপের মাঝে নয়টি রূপ বিশেষভাবে, বিশেষ লগ্নে পুজিত হয়ে থাকে।
শৈলপুত্রী, ব্রহ্মচারিণী, চন্দ্রঘণ্টা, কুশমণ্ডা, স্কন্দমাতা, কাত্যায়নী, কালরাত্রি, মহাগৌরী, সিদ্ধিদাত্রী-মহাশক্তি রূপে দেবী দুর্গা দেবকুল, সাধককুল, ভক্তকুলে পুজিত হয়ে থাকেন। তাই ঘরের মেয়েকে আমরা অনেকেই ভগবতী নাম দিই, স্বয়ং আরদ্ধ শক্তিকে মনে করার জন্য, নিজের বাড়ির ছেলে মেয়েদের এ সেই নাম দিয়ে রাখি আমরা অনেকেই।
তেমনি নামের বিশ্লেষণ হয়তো আমরা অনেকেই জানি না তবে দেবী দুর্গার আরেক নাম ভগবতী ,অনেক বাড়ির মেয়েদের নাম হয় ভগবতী। ভগবতী নামের উৎস শক্তি বা এর অর্থ কি আমরা হয়তো অনেকে জানিনা। সে কথাগুলো আজ আমি এই লেখার মধ্যে তুলে ধরছি। ভগবতী দূর্গা। ভগ মানে ঐশ্বর্য্য। তাই, ভগবতী মানে ঐশ্বর্য্যশালিনী। ঐশ্বর্য্য, বীর্য্য, যশ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয়টি ঐশ্বর্য্যরে নাম ‘ভগ’। এই ছয়টিই মা-দূর্গার মধ্যে পূর্ণ মহিমায় বিরাজিত।
আবার তিনি ‘মহামায়া’। মায়া কথাটি এসেছে মা-ধাতু থেকে, অর্থ পরিমাপ করা। মহামায়া মানে মহাপরিমাপনকর্ত্রী। পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘এই যে মায়া দেখছ, মায়ার যা সব খেলা, এ মায়া কিন্তু আমারই (গীতা ৭/১৪)। অর্থাৎ মায়াও তাঁরই সৃষ্টি। ঈশ্বর স্বীয় মহাশক্তি দ্বারা জগৎ পরিমাপিত করেন। মায়া আবার প্রকৃতি নামেও আখ্যায়িত হয়। দেবীপূজার প্রক্কালে বিল্লবৃক্ষে বোধন হয়।
বোধন মানে জাগরণ, চেতন করে তোলা।’বিবেক জাগ্রত না হলে বিশ্ব মানবতার সন্তান হয়ে ওঠার যোগ্যতা লাভ করা যায় না। শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন, ‘বোধন মানে বোধসূত্র, যাকে আশ্রয় করে অন্তরে বাহিরের যা কিছুকে বুঝে সুঝে চলতে পারা যায়। ’পূজা মানেই তো সংবর্ধনা অর্থাৎ যার পূজা করি তাঁর মহনীয় গুণাবলীকে সুনিষ্ট অনুশীলনের দ্বারা নিজেকে চরিত্রগত করে তোলা এবং ধীরে ধীরে তা বাড়িয়ে তোলা।
আরও পড়ুন: মেয়েদের ঘর সংসার এর সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে দেবী দুর্গার ইতিকথা
বলি হলো উৎসর্গ। আমাদের নিজেদের হিংস্রতা ও লালসাকে পোষণ করতে যেয়ে এরকম নিষ্ঠুরভাবে পশুহত্যা আমরা ক্রমাগত করে চলছি। তাতে পূজার উদ্দেশ্য কতখানি সিদ্ধ হচ্ছে? মন কতটা ভাগবৎমুখী হয়ে উঠছে? পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকের ওপর দরদী হয়ে ওঠার এই ক্রিয়া কতটা সহায়তা করছে? ইন্দ্রিয়গুলো আমাদের কতটা তীক্ষ্ণ ও তরতরে হয়ে উঠছে? কোনোটিই হচ্ছে না। কারণ, আমরা বলি শব্দের প্রকৃত অর্থ জানি না। তাই বলিদানও হয় না।
বলি শব্দ এসেছে বল্ ধাতু থেকে, মানে বর্দ্ধন। মায়ের পূজা যে বলি হয় তার মানে বেড়ে ওঠা বা বলীয়ান করে তোলা। মায়ের পূজা করে মানুষ সংবধিক হয়ে ওঠে।বিসর্জন শব্দটি বি-সৃজ ধাতু থেকে উৎপন্ন, বিশেষ প্রকারে সৃষ্টি করা। যে মাতৃপূজা করলাম, সেই মায়ের সর্ব মঙ্গলকারিণী স্নেহসুন্দরভাবে ও চরিত্রকে নিজের অন্তরে বিশেষভাবে সৃষ্ট, অর্থাৎ দৃঢ়নিবন্ধ করে তোলা চাই। মায়ের সেবায় আমাদের বৃত্তিগুলোকে নিয়োজিত করি, তখনই হয় বিসর্জনের স্বার্থকতা।মা দুর্গা সাধারণের কাছে দেবী দুর্গা, মহাময়া, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী, শ্রী চন্ডী প্রভৃতি নামে পরিচিত।
সর্বশক্তি স্বরূপিনী আদ্যাশক্তি হলেন এই মা দুর্গা। তাঁর দুর্গা নামটির মধ্যেই অসুর শক্তি নাশের পরিচয়। তিনি দুর্গ নামের এক দৈত্যকে বধ করে দুর্গা নামে খ্যাত হন। যুগে যুগে দেবতাদের কল্যাণের জন্য দেবী দুর্গা অত্যাচারী ভোগলোলুপ অসুরদের নিধন করেছিলেন। মা দুর্গা শত্রু বিনাশে যেমন ভয়ঙ্করী আবার ভক্ত বা সন্তানের কাছে তিনি তেমনি স্নেহময়ী জননী, কল্যাণ প্রদায়িনী।
আরও পড়ুন: শাস্ত্রে নবপত্রিকাকে বলা হয়েছে ‘নবপত্রিকাবাসিনী নবদুর্গা
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- ‘ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ। দুই নয়নে স্নেহের হাসি ললাট নেত্র আগুণবরণ।’কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথাটি স্মরণ করে বলতে চাই আজকের দিনে,শারদোৎসবের মূল আনন্দোৎসব শুরু হয়। মহাষ্টমীর মূল আকর্ষণ হলো কুমারী পূজা । কূমারীপূজায় একটি কূমারী মেয়েকে দেবীরূপে অর্পণ প্রদান করা হয়।
এই দিনটিতে সন্ধিপূজাও হয়। দেবী দুর্গা যখন অসুরনাশের জন্যে কালীর রূপ ধারণ করেন, সে সময়কালকে সন্ধিকাল বলা হয়। হিন্দু ধর্মবিশ্বাস মতে, সন্ধি পূজার মাধ্যমে দূর্গা দেবি সং আসেন প্রতিমার মধ্যে । সেই সময় মাকে সাক্ষী রেখে তাঁর সামনে কলা ও চালকুমড়ো উৎসর্গ করা হয়। এ কারণে অষ্টমীর দিনে বেশিরভাগ বাড়িতেই নিরামিষ আহারের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
মহানবমীর দিনে দেবীকে অন্নভোগ প্রদান করা হয়। মহানবমীকেই মূলত দুর্গাপূজার শেষদিন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। তার পরের দিন অর্থাৎ দশমীতে দেবী বিসর্জনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয় দুর্গোৎসবের। মহালয়ায় শুরু, বিজয়ায় শেষ! বিজয়ার দিনে দেবী দুর্গা তাঁর বাপের বাড়ি থেকে আবার শ্বশুর বাড়ি কৈলাসের উদ্দেশে রওনা দেন। এ দিনটিতে দেবীকে সিঁদুর খেলার মাধ্যমে বিদায় জানান সনাতনীরা। এরপর প্রতিমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ভাসানের জন্য। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে হিন্দুদের সর্ববৃহৎ বাৎসরিক ধর্মীয় উৎসবের।