আন্তর্জাতিক

বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট

বিশ্বজুড়ে দেশে দেশে অর্থনৈতিক সংকট

করোনা মহামারির পরে দেশগুলো নগদ অর্থসংকট ও ঋণে জর্জরিত হয়েছে। দরিদ্র দেশগুলোতে গড়ে জিডিপির অনুপাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ, যা বেড়েই চলছে।

এদিকে দরিদ্র দেশগুলোকে উচ্চ হারে সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের হিসাব মতে, ঝুঁকিতে রয়েছে ৪১টি দেশ। এরই মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে একটি দেউলিয়া রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে শ্রীলঙ্কা। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে আমদানি-ব্যয় মেটাতে পারছে না। পাশাপাশি ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হচ্ছে। এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের তীব্র আন্দোলনের মুখে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।

এছাড়া ল্যাটিন আমেরিকার দেশ পেরুতেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে, ভারতে সম্প্রতি অগ্নিপথ প্রকল্প নিয়ে বিক্ষোভ-সহিংসতা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানে মুদ্রা বাঁচাতে কম চা খেতে বলা হয়েছে। লাওসও ঋণ-খেলাপির দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাওয়ায় কম্বোডিয়ার জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব পড়েছে।

দ্য ইকোনমিস্ট খাদ্য- জ্বালানির মূল্যস্ফীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সম্পর্ক পরীক্ষা করার জন্য একটি পরিসংখ্যানগত মডেল তৈরি করেছে। যেকোনো ধরনের গণআন্দোলন, দাঙ্গা ও রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে এ বিষয়গুলো মুখ্য ভূমিকায় থাকে। ইকোনমিস্টের এই মডেল যদি সত্যি হয় তাহলে চলতি বছরে আরও অনেক দেশেই সহিংসতা দেখা দেবে।

সংকটের কারণে অনেক দেশ এরই মধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জর্ডান ও মিশর। দেশ দুইটি খাদ্য ও জ্বালানির ক্ষেত্রে আমদানির ওপর নির্ভরশীল। অনেক দেশের সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। সরবরাহ সংকটে তুরস্কের মূল্যস্ফীতি কয়েক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ হয়েছে। অনেক নাগরিক মনে করছেন আন্দোলন করলে তাদের হারানোর কিছু নেই।

ঘুষ-দুর্নীতিও সমাজকে অস্থিতিশীল করতে পারে। পণ্যের মূল্যর সঙ্গে যখন আয়ের সঙ্গতি না থাকে তখন অনেকে দুর্নীতির সঙ্গে জড়াতে পারে। নিম্নশ্রেণীর মানুষ শোষণের শিকার হতে পারে। এতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়বে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিউনিসিয়ায় চরম বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, যা আরব বসন্ত নামে পরিচিত।

চলতি বছরে যদি বিক্ষোভ ও অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। বিনিয়োগকারীদের কাছে দাঙ্গা কিংবা বিপ্লব পছন্দ নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, রাজনৈতিক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে জিডিপি কমে যায়।

একদিকে করোনা মহামারি, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দায় দেশে দেশে দেখা দিয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। এরমধ্যে শ্রীলঙ্কা যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে বিশ্বের আরও এক ডজন দেশ।

বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকট একটি দেশকে কতটা চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ শ্রীলঙ্কা। দেশটির এ অবস্থা বিশ্বজুড়ে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার এবং নাগরিকদের চরম দুর্ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। চোখ রাঙাচ্ছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি এবং বিশ্ববাজারে বিশৃঙ্খলা।

ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা, লেবানন, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জিম্বাবুয়ে ঋণ খেলাপি দেশে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বেলারুশসহ আরও অন্তত এক ডজন দেশ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে। এসব দেশের মাথার উপর অকল্পনীয় ঋণের বোঝা চেপে আছে।

বিশেষজ্ঞরা হিসাব করে বলেছেন, সংখ্যার হিসাবে এই ঋণের বোঝার পরিমাণ প্রায় ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ঋণের বোঝা আর্জেন্টিনার মাথার উপর। দেশটিকে ১৫ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। তারপর আছে ইকুয়েডর এবং মিশর। দেশ দুটিকে চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

যদিও বিশেষজ্ঞরা এখনো আশা ছাড়েননি। তারা বলছেন, যদি বিশ্ববাজার শান্ত হয়ে আসে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে বেশ কিছু সমর্থন পাওয়া যায় তবে হয়তো কিছু দেশ খেলাপি হওয়া এড়িয়ে যেতে পারবে।

যেসব দেশ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে

আর্জেন্টিনা: আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসো কালোবাজারে এখন প্রায় ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্টে লেনদেন হচ্ছে। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ বিপজ্জনক মাত্রায় কমে গেছে। ২০২০ সালে দেশটি তাদের ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। ওই সময় তাদের বন্ড বাণিজ্যের যে হার ধরা হয়েছিল এখন তারও প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। ২০২৪ সাল পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো যথেষ্ট ঋণ আর্জেন্টিনা সরকারের কাছে নেই।

ইউক্রেন: রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে ইউক্রেনকে অবশ্যই তাদের প্রায় দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ পুনর্গঠন করতে হবে। আগামী সেপ্টেম্বরে দেশটিকে ১২০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। যদি তারা সেটা পরিশোধ করতে না পারে তখনই সংকট দেখা দেবে।

সহায়তার অর্থ এবং রিজার্ভ থেকে সম্ভবত কিয়েভ তা পরিশোধ করতে পারবে। যদিও দেশটির রাষ্ট্র পরিচালিত জ্বালানি কোম্পানি ‘নাফতোগেজ’ এ সপ্তাহে দুই বছরের জন্য দেশটিকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা বন্ধ রাখতে বলেছে। বিনিয়োগকারীদের ধারণা দেশটির সরকার এই পরামর্শ অনুসরণ করবে।

তিউনিসিয়া: ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আফ্রিকা থেকে বেশ কয়েটি দেশ আইএমএফ-র সঙ্গে দেনদরবার করছে। তিউনিসিয়া সেগুলোর মধ্যে সবথেকে ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রায় ১০ শতাংশ ঘাটতি বাজেট এবং সরকারি কর্মীদের মজুরি হিসেবে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা দেশগুলোর একটি তিউনিসিয়া। দেশটির জন্য আইএমএফ প্রকল্প সুরক্ষিত রাখা বা অন্তত সেগুলো অনুসরণ করা কঠিন হবে। কারণ দেশটির প্রেসিডেন্ট কাইস সাঈদ দেশটির শাসনব্যবস্থার উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী করতে চাইছেন।

এদিকে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান মারুয়ান আব্বাসি বলেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সঙ্গে একটি চুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’

ঘানা: এ বছর ঘানার মুদ্রা সেডির মূল্য প্রায় একচতুর্থাংশ কমে গেছে। দেশটি এরই মধ্যে কর থেকে প্রাপ্ত তাদের রাজস্বের অর্ধেকের বেশি ঋণের সুদ প্রদানে ব্যয় করছে। সেখানে মুদ্রাস্ফীতি ৩০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।

মিশর: মিশরে ঋণ ও জিডিপির অনুপাত প্রায় ৯৫ শতাংশের কাছাকাছি। ফান্ড ফার্ম ‘এফআইএম পার্টনারস’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের ব্যয় মেটাতে মিশরের ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার নগদ অর্থের প্রয়োজন পড়বে। মিশর তাদের মুদ্রা পাউন্ডের ১৫ শতাংশ অবমূল্যায়ন করেছে এবং গত মার্চে আইএমএফ-র কাছে সহায়তা চেয়েছে।

কেনিয়া: কেনিয়া তাদের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ ঋণের সুদ প্রদানে ব্যয় করে। তাদের বন্ডের মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং বর্তমানে কোনো পুঁজি বাজারে তাদের প্রবেশাধিকার নেই।

ইথিওপিয়া: জি২০’র ‘কমন ফ্রেমওয়ার্ক প্রকল্পের’ আওতায় ঋণত্রাণ পাওয়া প্রথম দেশগুলোর একটি হওয়ার চেষ্টা করছে ইথিওপিয়া। চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির অগ্রগতি থমকে গেছে। যদিও এর মধ্যেও দেশটি তাদের একমাত্র ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের আন্তর্জাতিক বন্ড পরিষেবা চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে।

পাকিস্তান: পাকিস্তান এ সপ্তাহে আইএমএফ-র সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করেছে। দেশটির অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে ওই চুক্তিটি করতে পারা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি দরকারি ছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের অত্যধিক দাম বৃদ্ধি দেশটির আমদানি-ব্যয় ভারসাম্য পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে।

পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৯৮০ কোটি মার্কিন ডলারের নিচে নেমে এসেছে। যা দিয়ে দেশটির বড়োজোর তাদের পাঁচ সপ্তাহের ব্যয় মেটাতে পারবে। গত সপ্তাহের শেষে পাকিস্তানের মুদ্রার রুপির রেকর্ড অবমূল্যায়ন হয়েছে। দেশটির নতুন সরকারকে দ্রুত ব্যয় কমাতে হবে। কারণ এখন তাদের রাজস্ব আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ ঋণের সুদ প্রদানে ব্যয় করতে হবে।

বেলারুশ: পশ্চিমা কঠোর নিষেধাজ্ঞা গত মাসে রাশিয়াকে ঋণ খেলাপি করে ছেড়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর পক্ষে অবস্থান নেয়ায় এখন বেলারুশকেও একই কঠোর আচরণ মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

ইকুয়েডর: লাতিন আমেরিকার এই দেশটি মাত্র দুই বছর আগে একবার খেলাপি হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট গিয়েরমো লাসোকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে দেশজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ আবারও ইকুয়েডরকে অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া নাইজেরিয়া এবং এল সালভাদোরও একই কাতারে রয়েছে।

আরও পড়ুন ::

Back to top button