Jannah Theme License is not validated, Go to the theme options page to validate the license, You need a single license for each domain name.
সাহিত্য

পটুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়

দীপাঞ্জন দে

পটুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়

বাংলার পটুয়া সম্প্রদায় হল ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীন ভারতীয় জনজাতি। তাদের জাতিগত পেশা, সামাজিক অবস্থান, ধর্মীয় জীবনকে ন্যায্যতা দিতে তারা অনেকসময় নিজেদের প্রসঙ্গে এইরূপ বলে থাকেন—

“হাবিল পড়িল শাস্ত্র কাবিল কোরান
তাহা হতে সৃষ্টি হল হিন্দু মুসলমান।”
পটুয়াদের ধর্মীয় জীবন ও সমাজে তাদের অবস্থান নিয়ে পর্যালোচনা করা হলে দেখা যায় যে, তাদের ধর্মীয় জীবনে অদ্ভুতভাবে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছে এবং এর ফলে তাদের জীবনচর্যায় এক ধরনের সাংস্কৃতিক দোদুল্যমানতা বিরাজমান রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গের পটুয়া চিত্রকর সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত যে কাহিনীটির প্রসঙ্গ শুরুতে টানা হয়েছে, সেই কাহিনীটি হল— হাবিল ও কাবিল নামে দুই ভাই ছিল। তারা হাবা মায়ের সন্তান। বড় ভাই হাবিল ছিল হিন্দু, ছোট ভাই কাবিল ছিল মুসলমান। তাদের ছোট বোন আকালি, যে দেখতে সুন্দর। আর এক বোন গাছ বিবি, যে দেখতে খারাপ। হাবিল সবার বড়, তারপর যথাক্রমে গাছ বিবি, কাবিল ও আকালি মা। হবিল বিয়ে করে আকালি মাকে। আর কাবিল বিয়ে করে গাছ বিবিকে। এই ঘটনার পর শয়তান আসে। সে কাবিলকে বলে— তুই বোকা, বিশ্রী মেয়েকে বিয়ে করলি, আর তোর ভাই সুন্দর মেয়েকে বিয়ে করলো। পরিণামে তাদের ভাইয়ে ভাইয়ে সংঘর্ষ বাঁধল।

এতে ছোট ভাই মারা গেল। বড় ভাই চিন্তায় পড়লো, সে কাঁদতে লাগলো। সে ভাবতে লাগলো ছোট ভাইয়ের সৎকার কীভাবে করবে? এমন সময় সে দুটো কাক পাখি দেখল। তারা নিজেদের মধ্যে মারামারি করছিল। মারামারিতে একটি কাক মারা গেল। এরপর সে দেখল জীবিত কাকটা ঠোঁটে করে গর্ত খুঁড়ল এবং সেই গর্তে মৃত কাকটিকে শুইয়ে দিল। সেই থেকে সৃষ্টি হল কবর। এটি দেখে বড় ভাইও তার মৃত ভাইয়ের দেহটিকে কবর দিল। এই কাহিনীটি পশ্চিমবঙ্গের বহু পটুয়া চিত্রকরের মুখ থেকেই শোনা যায়। চিত্রকর, পটুয়ারা তাদের মিশ্র ধর্মীয় আচারবিচার প্রসঙ্গে এমন সব লোককথা শোনায়। এরকম অনেক কিংবদন্তি তাদের সম্পর্কে রয়েছে।

পটুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়

পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, বীরভূম, পুরুলিয়া, বর্ধমান, উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনায় যেমন মুসলিম পটুয়া রয়েছে, তেমনই হিন্দু পটুয়াও রয়েছে। কিন্তু তাদের ধর্মীয় জীবনে হিন্দু মুসলিম উভয় সংস্কৃতির প্রভাব লক্ষণীয়। যদিও মাত্রার ভিন্নতা রয়েছে। অর্থাৎ কোনো পটুয়া পাড়ায় মুসলিম রীতিনীতি বেশি মেনে চলা হয়, আবার কোথাও হিন্দু রীতিনীতি বেশি মানা হয়। পটুয়া চিত্রকরদের ধর্মীয় জীবনে সুস্থিতি না থাকায় তাদের শিল্পচর্চা ও জীবনচর্যায় হিন্দু-মুসলিম-উপজাতীয় বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ ঘটতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ পূর্ব মেদিনীপুরের একটি ক্ষেত্র সমীক্ষিত পটুয়া গানের কথা উল্লেখ করতে পারি।

পূর্ব মেদিনীপুরের মুসলিম ধর্মাবলম্বী ময়না চিত্রকরের কাছ থেকে গানটি সংগ্রহ করেছি। ময়না চিত্রকরের গাওয়া ‘বৃক্ষরোপণ’ পটুয়া গানটিতে সামাজিক সচেতনতার কথা বলতে গিয়েও হিন্দু দেবতার প্রসঙ্গ টানা হয়েছে। গানটির কথা এইরূপ—

“ও জনগণ সবাই মিলে কর গাছ রোপণ
নারকেল গাছের উপকার যে পাই
নারকেল কত কাজে লাগাই
ডাব জল ঢালি শিবের মাথায়
শাস্ত্রেতে লিখন”

পটুয়াদের মধ্যে যেমন মুসলিম পটুয়া রয়েছে, তেমনি হিন্দু পটুয়াও রয়েছে। তবে মুসলিম পটুয়া হোক বা হিন্দু পটুয়া, তাদের জীবনচর্যায় হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অদ্ভুত সমন্বয় লক্ষণীয়। মুসলিম পটুয়াদের জীবনচর্যায় যেমন অনেক হিন্দু রীতিনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, তেমনই হিন্দু পটুয়াদের জীবনচর্যায় অনেক মুসলিম অনুষঙ্গ চোখে পড়ে। পটুয়ারা অনেক সময় নিজেদের ধর্ম পরিচয় জাহির করতে কুণ্ঠাবোধ করেন। এর পেছনে সমাজে তাদের অবনমিত হওয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বলে মনে হয়। হিন্দু ও মুসলিম উভয় সমাজব্যবস্থাতেই তাদের ব্রাত্য বলে গণ্য করা হয়েছে। তাদের জীবনচর্যার অনেকাংশ তাই এখনও রহস্যময়।

পটুয়া সম্প্রদায়ের ধর্মীয় জীবনে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয়

পটুয়াদের অনেকেই একই সাথে নিজেদের হিন্দু ও ইসলামিক পরিচয় বহন করে। যেমন তাদের অনেকেরই দুটি নাম থাকে। একটি হিন্দু নাম, যেটি হিন্দু সমাজে সহজে চলাচল করতে লাগে এবং একটি মুসলিম নাম, যেটি তাদের মুসলিম সমাজে চলাচলে কাজে দেয়। জীবিকা সূত্রে তাদের দুটি পরিচয়ই কাজে দেয়। বিশেষত যখন হিন্দু দেবদেবীর পট নিয়ে তারা জীবিকা নির্বাহ করে তখন গোঁড়া হিন্দু ও গোঁড়া মুসলিম উভয় সমাজকে সামাল দিতেই তাদের অনেকসময় প্রকৃত ধর্ম পরিচয়টিকে আড়াল করতে হয়। বিস্তারিত ভাবে বলতে গেলে যখন তারা পট নিয়ে ভিক্ষা করতে একটা হিন্দু বাড়িতে যায় তখন অনেকসময় তাদের হিন্দু নামের আশ্রয় নিতে হয়।

আবার হিন্দু দেবদেবীর ছবি আঁকা ও পটের গানের মধ্য দিয়ে হিন্দু দেবদেবীর মহিমাকীর্তন করার জন্য অথবা মূর্তি গড়ার জন্য মুসলিম সমাজের রোষের মুখে তাদের পড়তে হয়। এক্ষেত্রে মুসলিম নাম গ্রহণ এবং প্রতিমা গড়া থেকে বিরত থেকে তারা কিছুটা ভারসাম্য রক্ষা করতে চায়। ইসলাম ধর্মে পৌত্তলিকতা নেই। তাই অধিকাংশ মুসলিম পরিচয় দানকারী পটুয়া সম্প্রদায়ের শিল্পীরা মূর্তি গড়া থেকে বিরত থাকেন।

পটুয়াদের ধর্মীয় উৎস অনুসন্ধান করলে পাওয়া যাবে এরা প্রথমে ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে এরা জাতে পতিত হয়। তাদের জাতে পতিত হওয়ার কাহিনীটি ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রয়েছে। আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক থেকে পটুয়া সম্প্রদায়ের উপর ইসলামীয় প্রভাব পড়তে থাকে। বিভিন্ন জেলার পটুয়া পাড়াগুলিতে ক্ষেত্রানুসন্ধান চালিয়ে দেখেছি যে, পটুয়াদের ধর্মীয় জীবন দোদুল্যমান। সমাজে তাদের ধর্মীয় অবস্থানটি সুস্থিত নয়। আসলে বারংবার তাদের ধর্ম পরিবর্তিত হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে।

ইতিহাস বলছে তারা হিন্দু যুগে হিন্দু, বৌদ্ধ যুগে বৌদ্ধ এবং মুসলিম যুগে মুসলিম। বিভিন্ন যুগে তারা সামাজিক অত্যাচারের শিকার হয়েছে এবং আর্থ-সামাজিক সুবিধার্থে নিজেদের ধর্ম পরিবর্তন করেছে। সমাজপতিদের কাছে তারা একাধিক বার মাথা নুইয়েছে। বর্তমানে তাই এই জনজাতির মধ্যে হিন্দু, মুসলিম ও উপজাতীয় জীবনচর্যার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ দেখা যায়।

লেখক: পিএইচডি গবেষক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদিয়া

আরও পড়ুন ::

Back to top button