নদীয়া

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো : বিষয় ভাবনা

দীপাঞ্জন দে

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো : বিষয় ভাবনা

“ওঁ দূং শ্রীশ্রীমজ্জগদ্ধাত্রীদুর্গায়ৈ নমঃ”— জগতকে যিনি ধারণ করেন তিনিই জগদ্ধাত্রী। তিনি হলেন জগৎপালিকা। নীলকণ্ঠ শিব হলেন তাঁর সঙ্গী। দুর্গারই আরেকটি রূপ হলেন জগদ্ধাত্রী। তিনি সিংহবাহিনী, ত্রিনয়নী, চতুর্ভুজা। তাঁর চার হাতে চারটি অস্ত্র দেখতে পাওয়া যায়— শঙ্খ, ধনুক, চক্র এবং বাণ। বামদিকের দুটি হাতে যথাক্রমে শঙ্খ ও ধনুক। আর ডান দিকের দুটি হাতে যথাক্রমে চক্র এবং বাণ।

ওঁ দূং সিংহস্কন্ধসমারূঢ়াং নানালঙ্কারভূষিতাম্।
চতুর্ভুজাং মহাদেবীং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।।
শঙ্খশার্ঙ্গসমাযুক্তাং-বামপাণিদ্বয়ান্বিতাং।
চক্রঞ্চ পঞ্চবানাঞ্শ্চ ধারয়েতঞ্চ দক্ষিণে।।

জগদ্ধাত্রী পুজোর ইতিহাস নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। প্রচলিত একটি মত হল— বাংলায় প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয় নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে। তখন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের রাজত্বকাল (১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.)। সেই থেকেই কৃষ্ণনগর তথা পশ্চিমবঙ্গে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা। আবার কেউ কেউ জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্রের উত্তর পুরুষ মহারাজা গিরিশচন্দ্র রায়ের (১৮০২-১৮৪১ খ্রি.) কথা বলে থাকেন।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো : বিষয় ভাবনা

নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এবং হুগলি জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো খুবই বিখ্যাত। চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর আলোকসজ্জা যেমন বিশেষভাবে নজর কাড়ে, তেমনি কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রতিমা দর্শনার্থীদের হৃদয় জয় করে। করবে নাইবা কেন? বিশ্বের দরবারে কৃষ্ণনগর যে তার মৃৎশিল্পের জন্যই প্রসিদ্ধ।

তবে বর্তমানে জগদ্ধাত্রী প্রতিমার পাশাপাশি কৃষ্ণনগরের ক্লাব বারোয়ারিগুলির হরেক রকম ‘থিম’ দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করছে। ২০২২ সালের জগদ্ধাত্রী পুজোতেই যেমন প্যারিসের আইফেল টাওয়ার থেকে শুরু করে দিল্লির লালকেল্লা, আগ্রা ফোর্ট, পুরীর জগন্নাথ মন্দির, রোমের থ্রেভি ফাউন্টেন সবই দেখতে পাওয়া যাবে। তবে শুধুমাত্র কৃষ্ণনগর এবং চন্দননগর এই দুটি জায়গায় জগদ্ধাত্রী পুজো হয় মনে করলে ভুল হবে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় কমবেশি জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। নদিয়া জেলার কথাই যদি বলি তবে শান্তিপুর ও তেহট্টর জগদ্ধাত্রী পুজোর কথা বিশেষভাবে বলতেই হয়। ইতিমধ্যে এই দুটি জায়গার জগদ্ধাত্রী পুজো বেশ চর্চিত।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো : বিষয় ভাবনা

কৃষ্ণনগরের অন্যতম বিখ্যাত পুজো হল চাষা পাড়ার বুড়িমা। ২০২২ সালে বুড়িমার পুজো ঘিরে উন্মাদনা যেন বিগত বছরগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে। পুজো কর্মকর্তাদের দাবি অনুযায়ী এ বছর হল বুড়িমার সার্ধ দ্বিশতবর্ষ। সেই ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে পুজো উদ্যোক্তারা এই বছর আয়োজনও করেছেন সেই মাত্রায়। বুড়িমার অলংকার প্রতিবছর দর্শনার্থীদের নজর কাড়ে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেজন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। এবছর বুড়িমার অলংকারের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

পূজার্থীদের বিশ্বাস বুড়িমা খুবই জাগ্রত। ফি-বছর হাজারে হাজারে মানুষ বহু দূর-দূরান্ত থেকে বুড়িমাকে দর্শন করতে আসেন। এ বছরও ব্যতিক্রম নয়। নবমীর সকাল থেকেই চাষা পাড়ার বুড়িমাকে দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড় উপচে পড়ে। পুজো প্যান্ডেলের সামনে থেকে দর্শনার্থীদের প্রায় এক কিলোমিটার লাইন দেখতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চাষা পাড়ার বুড়িমার বয়স যদি ২৫০ বছর বলা হয়, তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়কালেই (১৭২৮-১৭৮২ খ্রি.) এই পুজোর সূচনা হয়েছিল ধরতে হবে। যে বিষয়টি অবশ্যই আলোচনাসাপেক্ষ।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর মণ্ডপসজ্জায় ২০২২ সালে যে সমস্ত বিষয় ভাবনা দেখতে পাওয়া গেল, সেগুলি হল এইরূপ—

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো : বিষয় ভাবনা

পাত্রবাজার স্বীকৃতি ক্লাব : স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের বিষয়টি মাথায় রেখে দিল্লীর লালকেল্লার আদলে প্যান্ডেল সঙ্গে লাইট এবং সাউন্ড শো,

নগেন্দ্রনগরের যুবগোষ্ঠী (যুব মাতা) : জারোয়ার দেশ আন্দামান,

প্রভাত সংঘ (মা শেরাবালী) : পুরীর জগন্নাথ মন্দির (বিশেষ আকর্ষণ হল মায়ের গায়ে বাদামের সাজ),

আমিন বাজার বারোয়ারি (মিষ্টি মা) : পুণের স্বামী নারায়ণ মন্দিরের আদলে ৮০ ফুট উচ্চ মণ্ডপ,

কালীনগর রেনবো ক্লাব : দক্ষিণ সিকিমের নামচির চারধাম,

পল্লীশ্রী বারোয়ারি : সত্যযুগ (মহারাজা তোমারে সেলাম),

রাজারোড ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি (রাজ মাতা) : প্রজাপতির দেশে,

ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি : মহারাষ্ট্রের আদিবাসী শিল্পকলা ও সংস্কৃতি,

পালকি (জগৎ মাতা) : সহজ পাঠ,

ক্লাব রেনেসাঁস : শিবালয়,

ক্লাব প্রতিভা (সন্ধ্যারামনগর) : বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রী (প্রায় একান্ন ফুট উচ্চতার জগদ্ধাত্রী প্রতিমা),

রাধানগর অন্নপূর্ণা সরণী (অন্ন মাতা) : সিকিমের রাভাংলা বুদ্ধ পার্ক (বিশেষ আকর্ষণ ৬০ ফুট উচ্চ বুদ্ধ মুর্তি),

রাধানগর আদি বারোয়ারি (সেরা মা) : তামিলনাড়ুর কোয়েম্বাটুরের আদি যোগী (এছাড়া বিশেষ লাইট এবং সাউন্ড প্রদর্শনী),

শক্তিনগর এম এন বি ক্লাব : আগ্রাদুর্গ (৫০ ফুট উচ্চ ও ৯০ ফুট চওড়া থিম),

রাধানগর নতুন বারোয়ারি (কৃষ্ণ মাতা) : গুজরাটের স্বামী নারায়ণ মন্দির,

নতুন সড়ক ষষ্ঠীতলা বারোয়ারি (হৈমন্তী মাতা) : ইন্ডিয়া গেট,

ক্লাব অনন্যা : রোমের থ্রেভি ফাউন্টেন,

এম জি রোড বারোয়ারি (রাজেশ্বরী মাতা) : আসামের কৈলাসনাথ মন্দির,

বৌবাজার বারোয়ারি (মা মাহেশ্বরী) : যা পাখি উড়তে দিলাম তোকে,

বাগদীপাড়া বারোয়ারি : শিশু সাহিত্যশিল্পী ও কার্টুনিস্ট নারায়ণ দেবনাথকে শ্রদ্ধার্ঘ্য,

রায়পাড়া মালিপাড়া বারোয়ারি : রাধাকৃষ্ণের নাট মন্দির,

মালিপাড়া ইন্দিরাপল্লী বারোয়ারি (গরীবের মা) : কয়লা খনি,

হাতার পাড়া বারোয়ারি (মা মধ্যমণি) : দুয়ারে বদ্রীনাথ,

কালীনগরের ক্লাব আমরা সবাই (রাজেশ্বরী মাতা) : এক টুকরো আমাজন,

ক্লাব মাদল : যুগান্তর,

প্রীতি সম্মিলনী : মাটির টানে, মায়ের ঘরে, কংক্রিটের এই শহরে, এক টুকরো বাংলা গ্রাম,

ক্লাব রয়্যাল : বাদ্যযন্ত্র সামগ্রী,

ছুতোর পাড়া বারোয়ারি : এক টুকরো গ্রাম বাংলা,

কর্মকার বাড়ি : যাপনচিত্র,

রাজদূত ক্লাব (রাজ মাতা) : ভূতের রাজা,

কাপড়ের পটি বারোয়ারি (নরসিংহী মা) : ভারততীর্থ,

রাধানগর শিবমন্দির বারোয়ারি (শিব মাতা) : পরীর দেশে,

দর্জিপাড়া বারোয়ারি : বারো মাসে তেরো পার্বণ,

চৌধুরীপাড়া বারোয়ারি : বাংলার লোকশিল্প,

শক্তিনগর পাঁচমাথা মোড় বারোয়ারি : গ্রাম বাংলার দৃশ্য,

গোলাপটি বারোয়ারি : আনন্দ,

ক্লাব বন্ধুরা : মিডিয়া — প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, ডিজিটাল,

কলেজ স্ট্রীট বারোয়ারি (মেজো মা) : উদযাপন,

চকের পাড়া বারোয়ারি (আদি মা) : নিরুদ্দেশের খোঁজে (বিশেষ আকর্ষণ লাইটিং-এ থিম আলোয় ভুবন ভরা),

গোয়াড়ী বালকেশ্বরী বারোয়ারি (বালকেশ্বরী মাতা) : পথের পাঁচালী,

অঞ্জনা পাড়া বারোয়ারি : মায়ের পেটে মা,

ক্লাব পারিবারিক : পরিবেশ বাঁচলে মানব সভ্যতা বাঁচবে,

গড়াইপাড়া বারোয়ারি : গ্রামীণ শিল্পকলা।

ঘূর্ণী দাসপাড়া বারোয়ারি : ২৫৩ বছরের পুরোনো ফাঁসির মঞ্চ,

ঘূর্ণী তুফান সংঘ (দেবী মা) : প্যারিসের আইফেল টাওয়ার,

ঘূর্ণী আনন্দনগর বারোয়ারি (আনন্দ মাতা) : বদ্রীনাথের বদ্রী বিশাল মন্দির,

ঘূর্ণী ভাই ভাই ক্লাব (সেরা মা) : মানি হেইয়েস্ট (ব্যাঙ্ক অফ স্পেন),

ঘূর্ণী নবারুণ সংঘ (মা নবারুণেশ্বরী) : আলোকচিত্রসহ প্লাইউডের ৪০ ফুট উচ্চ ২৭ ফুট চওড়া দিল্লীর ইন্ডিয়া গেট সঙ্গে নেতাজীর মূর্তি,

ঘূর্ণী শরৎ স্মৃতি সংঘ (শরৎ মাতা) : কুলো, চাটাইয়ের মন্ডপসজ্জা ও সাথে বুলনের সাজে প্রতিমাসজ্জা,

ঘূর্ণী আদি ঘরামী পাড়া বারোয়ারি (চন্দ্রমাতা) : নো ওয়াটার নো লাইফ,

ঘূর্ণী শিবতলা বারোয়ারি (সুন্দরী মা) : ফিরে দেখা শৈশব,

ঘূর্ণী বিন্দুপাড়া বারোয়ারি (চন্দ্রমাতা) : মৎস্য কন্যা,

ঘূর্ণী স্মৃতি সংঘ (স্মৃতি মাতা) : ধর্ম নিরপেক্ষ পৃথিবী।

কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো এভাবেই এবছরও দর্শনার্থীদের মন কাড়ছে।

লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া

আরও পড়ুন ::

Back to top button