জাতীয়

চার বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের

চার বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ এসেছিল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়

প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি এমন একজন রাজনীতিক যিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সামলেছেন ভারত সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রক- অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা ও বিদেশ মন্ত্রক। গান্ধী পরিবারের তিন প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করেছেন তিনি। এছাড়া তিনি এমন একজন রাজনীতিক যিনি ৬ দশকের কর্মজীবনে বিরোধী রাজনীতিকদেরও সম্মান পেয়েছেন। রাজনৈতিক ময়দানে যাঁর এত কৃতিত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতা, তিনি কখনও দেশের প্রধানমন্ত্রী হননি।

রাজনীতিতে প্রায় প্রতিটি প্রজন্মেই তাঁর সক্রিয়া ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু তবুও শীর্ষ পদে তাঁর স্থান হয়নি। ২০০৪ সালে এই শীর্ষ পদে তাঁর স্থান হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী হিসেবে সলমন খুরশিদ তাঁর অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছিলেন, সেই সময়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বদলে মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বেছে নেওয়া শুধু কংগ্রেস দলের সদস্যদেরই নয়, বহিরাগতদেরও অবাক করেছিল। সেই সময়ে কংগ্রেসের সবচেয়ে সিনিয়র নেতা তিনিই ছিলেন।

আরও একটি বিষয় প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনে তাত্‍পর্যপূর্ণ। ১৯৮৪ এ ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পরে কংগ্রেসের থেকে তাঁর রাস্তা ৫ বছরের জন্য আলাদা হয়ে যায়। বলা হয়, কংগ্রেস ছাড়ার পিছনে ছিল তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। জানা যায় তিনি সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দলের সমর্থন ছিল রাজীব গান্ধীর সঙ্গে। সেই সময়ে প্রণব মুখোপাধ্যায় নিজের রাজনৈতিক সংগঠন খুলেছিলেন- রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস।

১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর আমন্ত্রণে প্রণব মুখোপাধ্যায় ফিরে আসেন। কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দল যুক্ত হয়।

প্রধানমন্ত্রীর পরবর্তী মর্যাদা পূর্ণ পদটি হল রাষ্ট্রপতি পদ। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। প্রণব মুখোপাধ্যায় শুধুমাত্র অর্থ, বিদেশ এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রকই সামলাননি। ভারতের আয়কর আইনের পর্যালোচনা করার জন্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ১০ বছরের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব স্বাক্ষর করার জন্য তাকে মনে রাখা হয়।

আরও পড়ুন : আর শোনা যাবে না ঘরের ছেলের গলায় চণ্ডীপাঠ

রাজনীতির ময়দানে বহু বন্ধু ছিল তাঁর। গতবছর ২০১৯ এ তাকে এন ডি এ সরকারের পক্ষ থেকে ভারতরত্নে ভূষিত করা হয়। যারা প্রণব মুখোপাধ্যায় কে খুব কাছ থেকে চিনতেন তারা জানেন তিনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বহু বন্ধু বানিয়ে ছিলেন। এই গুণ ২০১২-য় লোকসভা স্পিকার পি এ সাংমাকে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হতে সাহায্য করেছিল। ২০১৭ পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শাকিল আহমেদ যিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কাজ করেছিলেন বহু বছরের জন্য তিনি বলেছিলেন, ‘সাংমা একজন সিনিয়র আদিবাসী নেতা ছিলেন। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সমর্থনের জন্য আমরা যে দলগুলির কাছে পৌঁছে ছিলাম তার মধ্যে ছিল ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা। এই দল দ্বিধাগ্রস্ত ছিল।

ক্যাম্পেন চলাকালীন আমি যখন ঝাড়খন্ডে কংগ্রেসের ইনচার্জ হিসেবে ছিলাম প্রণব মুখোপাধ্যায় আমাকে ফোন করে শীঘ্র রাঁচিতে পৌঁছানোর জন্য অনুরোধ করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা তখনই সমর্থন করবেন যখন দেখবেন যে সাংমার আগে গিয়ে আমরা তাদের যোগাযোগ করেছি। পরের দিন আমি জেএমএম নেতার সঙ্গে আমি দেখা করি আর বাকিটা ইতিহাস।’

শাকিল আহমেদ আরও বলেছিলেন যে ‘প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ। যখনই তার কাছে কেউ কোনো সমস্যা নিয়ে যেতেন, তিনি তার কাছে তিন থেকে চারটি অপশন দিতেন। প্রত্যেকটির কী ফলাফল হতে পারে সেটিও বলতেন। এটি একটি অভ্যাস ছিল।’

১৯৬৯ সালে রাজনৈতিক যাত্রা শুরু করেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তত্‍কালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাকে বেছে নিয়েছিলেন এবং সাংসদ হিসেবে তাকে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ দিয়েছিলেন। রাজনীতির ময়দানে তিনি নতুন ছিলেন। কিন্তু তার বাবা কমদা কিংকর মুখোপাধ্যায় কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে যুক্ত একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন।

রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করার ঠিক চার বছরের মধ্যে তার জীবনের অন্যতম বড় ঘটনাটি ঘটে। ১৯৭৩ সালে তিনি ইন্দিরা গান্ধী দ্বারা শিল্প উন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ শালী যখন দেশে জরুরি অবস্থা জারি হল তখন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৯৮২ সালে তিনি অর্থমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন।

রাষ্ট্রপতি হিসেবে যেদিন শপথ নিলেন সেদিন প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘বাংলার ছোট্ট গ্রাম থেকে দিল্লির ঝাড়বাতি অবধি আমি বহু অবিশ্বাস্য পরিবর্তন দেখেছি।’

আরও পড়ুন : শিক্ষকতা ছেড়ে সাংবাদিকতা করেছিলেন প্রণব মুখার্জি

প্রণব মুখোপাধ্যায় জীবন নিয়ে বই লিখেছেন সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী। তিনি বলছেন, ‘তিনি যা কিছু অর্জন করেছেন সব নিজের মেধায়। একেবারে ঘোড়ার রাজনীতি করে তিনি জাতীয় পর্যায়ের এসেছিলেন। তার জীবনে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন এবং ৪ বার তার কাছে সেই সুযোগ ছিল কিন্তু বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়নি।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘সব সময় প্রথম সারির রাজনীতিকদের মধ্যে তিনি ছিলেন। কিন্তু নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ১০০ শতাংশ বিশ্বাস তিনি অর্জন করতে পারেননি। কার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য কিছু অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল। এবং একটা ভয় ছিল যে এই ব্যক্তি গান্ধী পরিবার কে ছাপিয়ে যেতে পারেন। তাই একজন বলতেই পারেন যে এটি প্রাসাদের রাজনীতি যেখানে তাকে প্রত্যেক প্রধান নেতা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি কখনও সেই বিশ্বাস অর্জন করতে পারেননি।’

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক জীবনের উন্নতি হতে থাকে ৯ এর দশকে এবং প্ল্যানিং কমিশন এর চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৯৫ সালে পি ভি নরসিমা রাও এ সরকারের সময় তিনি বিদেশমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। সোনিয়া গান্ধীকে দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তার যথেষ্ট ভূমিকা ছিল এবং তারপরেই ২০০৪ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকার পড়ে যায়। সকলে তখন ভেবেছিলেন সোনিয়া গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করবেন প্রণব মুখোপাধ্যায় কে।

কিন্তু ফের তিনি সুযোগ হারান। মনমোহন সিং কে বেছে নেন তিনি। অদ্ভুত বিষয় হলেও সেই সময় মনমোহন সিং ছিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান ছিলেন। অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী ছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। অতএব প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর মনমোহন সিং এর অধীনে চলে গেলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আরও পড়ুন : সাতদিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হবে ‌দেশে

‘তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এমন ছিল যে প্রত্যেকের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক বজায় ছিল। জনসাধারণের নেতার তিনি ছিলেন না কিন্তু একজন মাস্টার স্ট্র্যাটেজিস্ট ছিলেন। তার জীবনের একটি বেদনা হলো তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। তিনি জানতেন, তিনি যা চাইতেন সেটা কেন তিনি হতে পারেননি। তিনি নিজেই বলেছিলেন হিন্দি বলতে না পারার জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি।’

১০ বছরের ইউপিএ সরকারে তাকি সমস্যার সমাধান হিসেবে মনে করা হতো। ধর্ম নিরপেক্ষ হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। এছাড়া সারা ভারতের কাছে বাঙালির ভদ্রলোক হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন।২০১৫ শালী তার স্ত্রী শুভ্রা মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হয়। টার্মি শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় রাজনৈতিক ধারা বজায় রেখেছেন। দিল্লির কংগ্রেস নেত্রী তিনি। এবং ছেলে অভিজিত্‍ মুখোপাধ্যায় লোকসভার সাংসদ।

 

 

সুত্র: কলকাতা24×7

আরও পড়ুন ::

Back to top button