কলকাতা

“স্বাধীনতা আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা এক নয় ” – মন্তব্য করলেন ‘ঐক্য বাংলা’র সাধারণ সম্পাদিকা শ্রীমতী সুলগ্না দাশগুপ্ত

"স্বাধীনতা আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা এক নয় " - মন্তব্য করলেন 'ঐক্য বাংলা'র সাধারণ সম্পাদিকা শ্রীমতী সুলগ্না দাশগুপ্ত

নারীবাদের বিরোধিতা করে অনেক দিন থেকে ই বিতর্কে বাংলার প্রথম মুক্ত পন্থী বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগঠন ঐক্য বাংলার নেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা সুলগ্না দাশগুপ্ত। নিজে একজন শিক্ষিতা এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ভাষা অধিকার কর্মী হয়ে ও এই বিতর্কিত, পিছিয়ে থাকা দৃষ্টিকোণ এর তাৎপর্য কি?
এ বিষয়ে তাঁর সর্বপ্রথম সাক্ষাৎকারে মুখ খুললেন সূলগ্না।

সরাসরি মূল প্রশ্নে চলে যাই। আপনি নারী হয়ে এত নারীবিরোধী কেন?

আমি একদমই নারী বিরোধী নই। আমি নারীবাদ বিরোধী। আমি লিবার্টারিয়ান বা মুক্ত পন্থী। তাই স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তির অধিকারে বিশ্বাসী। কোন লিঙ্গ ভিত্তিক গোষ্ঠীর বিশেষ অধিকারে নয়। সেজন্যেই, আমি লিঙ্গ সাম্য বিরোধী তো নয়ই, লিঙ্গ সাম্যে গভীরভাবে বিশ্বাসী বলেই নারীবাদ বিরোধী।

কিন্তু ভারতের বাস্তবে আপনার অবস্থান এর প্রাসঙ্গিকতা কি? নারীর বিশেষ অধিকার তো দূরের কথা নূন্যতম অধিকার টুকুও নেই।

একদমই তাই। কন্যা ভ্রুণ হত্যা, পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ, বধু হত্যা, ধর্ষণ – এগুলো ভারতীয় সমাজের এক একটা কলঙ্ক। যদিও এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ এর প্রভাব কিন্তু বাঙালি সমাজে হয় নেই অথবা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এগুলো আমাদের শিক্ষার বা সমাজের অংশ নয়। এগুলো মূলত কয়েকটি উত্তর ভারতীয় সমস্যা।

যাইহোক। যেকোনো সচেতন ভারতীয়ের মতো আমিও এগুলো সমূলে নির্মূল করতে চাই। আমি স্বপ্ন দেখি এরকম ভারতের যেখানে প্রত্যেক নারীর পুরুষের সাথে সমান শিক্ষার অধিকার, অর্থোপার্জনের অধিকার, সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার, অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি নিরাপত্তা – এগুলো থাকবে।

আর এ জন্যেই বললাম আমি লিঙ্গ সাম্যের পক্ষে এবং নারীবাদ এর বিপক্ষে। তার কারণ হচ্ছে, আমি চ্যালেঞ্জ করছি – আজকের দিনে একজন বিখ্যাত নারীবাদী দেখান যিনি ভারতের এই প্রকৃত লিঙ্গ বৈষম্য গুলো নিয়ে একটা টু শব্দ করছেন। যদি কেউ থাকেন আমি 200% সেই নারীবাদী কে সমর্থন করবো।

"স্বাধীনতা আর সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকা এক নয় " - মন্তব্য করলেন 'ঐক্য বাংলা'র সাধারণ সম্পাদিকা শ্রীমতী সুলগ্না দাশগুপ্ত

কিন্তু সাধারণত নারীবাদীরা কিছু বিতর্কিত বিষয় – যেমন যৌনতা সংক্রান্ত যেকোন বিষয় – এগুলো নিয়ে বেশি আলোচনা করে প্রচারের আলোয় থাকতে পছন্দ করেন। আমি তো মনে করি আমার মত নারীবাদবিরোধীদের থেকে, আজকের দিনে পেশাদার নারীবাদীরা লিঙ্গ সাম্যের অনেক বড় শত্রু। কারণ পূর্বোক্ত প্রকৃত সমস্যাগুলো থেকে মিডিয়া অ্যাটেনশন ঘুরিয়ে নিজেদের ওপর নিয়ে এসে তাঁরা ভারতের প্রকৃত লিঙ্গ সাম্যের শিকার যে নারীরা, তাঁদের বঞ্চিত করছেন।

আপনি ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বললেন। নিজের খুশিমতো পোশাক পরা কি একটা মৌলিক ব্যক্তি অধিকার নয়? সামাজিক মাধ্যমে অনেকবারই আপনি নারীর পোশাকের স্বাধীনতার বিরোধিতা করছেন বলে মনে হয়েছে।

খুব ভালো প্রশ্ন। মুক্ত পন্থা পরিচয় নির্বিশেষে প্রত্যেক ব্যক্তির সমান মৌলিক অধিকারের কথা বলে। কিন্তু অন্যের সমালোচনা থেকে মুক্তি, অন্যের চোখে সম্মানের জায়গায় থাকা – এগুলো কোন মৌলিক ব্যক্তি-অধিকার নয়। আমি নারী সহ যে কোন ব্যক্তির 100% পোশাকের স্বাধীনতার 100% পক্ষে।

ঠিক যে কোনও পোশাক পরা যেরকম যেকারো মৌলিক অধিকার, অন্যের সমালোচনাও সেরকম প্রত্যেক ব্যক্তির মৌলিক অধিকার। একই সাথে আমি খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই – আমি একদমই মনে করিনা নারীর কোন রকম ব্যবহার, চালচলন অথবা পোশাক কাউকে সেই নারীর বিরুদ্ধে কোনো যৌন অপরাধ করার অধিকার দেয়। একদমই না। একটা অপরাধ হলো একটা অপরাধ। যে কোন নারী যে কোন পোশাক পড়ুক,সেটা কাউকে সেই নারীর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করার অধিকার কোন অবস্থাতেই দেয় না।

কিন্তু আবারও বলব – সমালোচনা করা বা কাউকে অসম্মানের চোখে দেখা অপরাধ তো নয়ই, বরং একটি মৌলিক অধিকার। নারীবাদীরা একটা কথা বলে থাকেন, “মহিলাদের পোশাকের জন্য “জাজ” করা তাদের অধিকার খর্ব করে।” আমি একমত না। যে কোন পোশাক পরা অবশ্যই ব্যক্তি অধিকার। জাজমেন্ট বা সমালোচনা থেকে মুক্তি কারো অধিকার নয়।

সাম্প্রতিককালে আপনার পাঞ্চালি কর বলে এক ব্যক্তি র কিছু নগ্ন ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আপনি পাঞ্চালির নগ্ন ছবি গুলিকে করোনাভাইরাস এর সাথে তুলনা করে বলেছেন এগুলো দেখলে মানুষের বমনোদ্রেক হয়। এগুলো কি ব্যক্তি আক্রমণ নয়?

হাহা। এটা আশা করি সকলে বুঝতেই পারছেন যে এই পোস্ট টি একটু হালকা চালে করা ছিল। মানেটা অবশ্যই আক্ষরিক নয়। যাই হোক। হ্যাঁ পোস্টটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক ছিল তো বটেই, কিন্তু ওটাকে আমি “আক্রমণ” বলবো না। সমালোচনা বা হাসি মশকরা করা – অবশ্যই।

পাঞ্চালি কর বলে ওই ব্যক্তি এই ছবিগুলি স্বেচ্ছায় নিজের প্রোফাইলে পাবলিকলি পোস্ট করেছেন। সুতরাং তখনই তিনি পাবলিককে এই ছবিগুলো নিয়ে যেকোন রকমের মন্তব্য, সমালোচনা, নিজেদের মধ্যে আলোচনা ইত্যাদি করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন। পাবলিক পোস্ট এর মানে ই তাই। আবারো বলবো – পাঞ্চালির নিজের নগ্ন ছবি স্বেচ্ছায় পাবলিকলি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করার অধিকারের আমি সম্পূর্ণ পক্ষে। এটি অবশ্যই ওনার মৌলিক ব্যক্তি অধিকার। সেভাবেই এটা নিয়ে যেকোন রকম নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করা আমাদের সবাইকার মৌলিক অধিকার। আমি ওনার ওপর কোনো রকম যৌন বা অন্য রকম অপরাধমূলক আক্রমণ সমর্থন করিনা।

আপনি দেখা গেছে বিয়ের ক্ষেত্রে কুমারী মেয়ে খোঁজার পক্ষে। এটা কিভাবে ব্যক্তিস্বাধীনতার বিরোধী নয়?

আমি ব্যক্তি স্বাধীনতার পক্ষে। আগের আলোচনার রেস টেনে বলি – অনেকেই বলেন নারীর স্বল্পবাস তাঁদের অস্বস্তিতে ফেলে। কিন্তু একজন মুক্ত পন্থী হিসেবে আমি মনে করি অন্যে কি পরল তাতে এই ব্যক্তিদের – অস্বস্তি যদি হয় ও – অধিকার কোন ভাবেই খর্ব হচ্ছে না। যা আগেই বললাম – অন্যের অস্বস্তি হলেও, যে কোন পোশাক পরা যে কোন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার।

ঠিক সেভাবেই – অন্যের অস্বস্তি হলেও – আপনি কাকে বিয়ে করবেন, সেটা কি ক্রাইটেরিয়ার ভিত্তিতে ঠিক করবেন, সেটা নির্ধারণ করার 100% অধিকার আপনার এবং আপনার হবু স্ত্রী বা স্বামীর। এই দুজন ব্যক্তি ছাড়া পৃথিবীর যে কারোর যত অস্বস্তিই হোক না কেন, তাদের এই সিদ্ধান্তের উপর কোন অধিকার নেই। কোন ব্যক্তি যদি খোলাখুলিভাবে জানান যে তিনি বিয়ের জন্য কুমারী মেয়ে খুজছেন, এবং কোন কুমারী মেয়ে যদি সেটা জেনে বুঝে তাকে বিয়ে করে, তাতে আমার আপনার কি বলার থাকতে পারে?

নারীবাদীরা অনেক সময় রক্ষণশীলদের উদ্দেশ্যে বলে থাকেন, “আপনার যদি কোন পোশাক পছন্দ না হয়, সেটা পড়বেন না। ব্যাস এইটুকুই আপনার অধিকার। এর বেশি নয়।” আমি এ ব্যাপারে তাঁদের সাথে 100% একমত। আপনার যদি মনে হয় কুমারীত্বর ভিত্তিতে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয়, নেবেন না, এবং যারা কুমারিত্ব নিয়ে চিন্তিত তাদের বিয়ে করবেন না। ব্যস মিটে গেল। এর বাইরে এ ব্যাপারে আপনার কোন অধিকার নেই।

বিবাহের পূর্বে যৌনমিলন বা নারীর একাধিক যৌন সঙ্গী থাকা নিয়ে আপনার কি বক্তব্য?

বিবাহের পূর্বে যৌন মিলন অথবা একাধিক যৌনসঙ্গী থাকা স্বাভাবিকভাবেই একটি মৌলিক ব্যক্তি স্বাধীনতা। এ নিয়ে কোনো দ্বিতীয় কথাই নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে এগুলোর জন্য কাউকে জাজ করিনা। এসব কারণে যদি কেউ কোন মেয়েকে বিয়ে করতে বা তার সাথে সম্পর্কে যেতে না চায় সেটাও তাদের ব্যাক্তিস্বাধীনতা। তাদেরও জায করিনা।

একটা কথা বলি – দেখেছেন তো এই তথাকথিত নারীবাদ সংক্রান্ত আলোচনাতে আমরা কিরকম যৌনতা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই পুরো আলোচনাটা করছি? এজন্যই আমি নারীবাদকে অন্তঃসারশূন্য হিসেবে দেখি। নারীবাদি দের বিরোধিতা করলে তাঁরা বধূ হত্যা আর ধর্ষণ কে সামনে নিয়ে এসে নারীবাদী আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা প্রমাণের চেষ্টা করবেন, কিন্তু ওনাদের কাছে নারী অধিকারের প্রশ্নে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কি এগুলো জিজ্ঞেস করলে উনারা যৌনতা ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতে আগ্রহ দেখাবেন না।

আপনার সমালোচনা মেনে নিলাম। সবশেষে একটা অন্যরকম প্রশ্ন। আপনি বললেন মুক্ত পন্থী হিসেবে আপনি ব্যক্তির অধিকার এ বিশ্বাসী, কোন বিশেষ গোষ্ঠীর অধিকারে নয়। এটা কিভাবে আপনার বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শের সাথে খাপ খায়?

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এই প্রশ্নটা করার জন্য। এটা আমার প্রিয়তম প্রশ্ন।

আমাদের মৌলিক দাবি – ভারতের মাটিতে সমস্ত জাতির সমানাধিকার। কোন বিশেষ অধিকার অনেক পরের কথা।

আগের ওই কথা আমি নারীবাদ এ র প্রসঙ্গে বলেছিলাম। আপনি এমন একটি আইন বা সরকারি বা বেসরকারি নিয়ম দেখান যেখানে নারীকে লিখিতভাবে পুরুষের থেকে কম অধিকার দেওয়া হয়েছে। আমি আপনাকে সংবিধান থেকে শুরু করে সরকারি বিভিন্ন পরীক্ষা, বেসরকারী চাকরীতে নিয়োগ ইত্যাদি হাজারটা উদাহরণ দেখাতে পারি যেখানে লিখিতভাবে, সরাসরিভাবে বাঙালিকে হিন্দি ভাষী র থেকে কম অধিকার দেওয়া হয়েছে। আমাদের আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা সেখানেই।

বেশি কিছু নয়, সংবিধান থেকে যেদিন হিন্দি ভাষীর বিশেষ অধিকারের অংশটা উঠে যাবে – লিঙ্গের ক্ষেত্রে যেখানে সংবিধানে সরাসরিভাবে লিঙ্গবৈষম্যকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়েছে, যেটা নিয়ে ভারতীয় হিসেবে আমি অবশ্যই গর্বিত – সেদিন আর আমাদের আন্দোলন এর প্রয়োজন হবে না। আমিতো সেই দিনেরই স্বপ্ন দেখি, যেদিন আমাদের আন্দোলনের আর প্রয়োজন হবে না, কারণ ভাষা নির্বিশেষে প্রত্যেক ভারতিয়ের ভারতের মাটিতে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

 

আরও পড়ুন ::

Back to top button