বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রীর জন্য ২০২২ সালের জগদ্ধাত্রী পুজো অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী’ কথাটির মধ্যেই এক প্রকার রোমাঞ্চ রয়েছে। ঘোষণার সাথে সাথেই দর্শনার্থীদের মুখে মুখে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রীর কথা প্রচারিত হয়ে গেছে। কৃষ্ণনগরের ক্লাব প্রতিভার সৌজন্যে দেখা মিলল বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রীর। ২০২২ সালে কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজোর অন্যতম আকর্ষণই ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী।
কৃষ্ণনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে মাজদিয়া যাওয়ার রাস্তায় কিছুটা গেলেই ক্লাব প্রতিভার মাঠটি দেখতে পাওয়া যায়। সেই মাঠেই হয়েছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী। কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই মানুষের বিশেষ উন্মাদনা দেখতে পাওয়া যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম ছিল না। হুগলি জেলার চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজোও বেশ ধুমধাম করে হয়।
বহু পর্যটক প্রতিবছর পুজো দেখতে সেখানে যান। তবে কৃষ্ণনাগরিকদের কাছে চন্দননগরের থেকেও তাদের শহরের পুজোই হল সেরা। আর ২০২২ সালে তো বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রী গড়ে কৃষ্ণনগর বিগত সকল রেকর্ড ছাপিয়ে গেল। বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী প্রতিমা দেখার জন্য কৃষ্ণনগরের প্রতিভা ক্লাবের মাঠে এবছর জনসমুদ্র দেখতে পাওয়া গেল। জগদ্ধাত্রী পুজোকে কেন্দ্র করে ক্লাবের মাঠে মেলাও বসেছিল। বিশ্বের সবথেকে বড় জগদ্ধাত্রী প্রতিমা দেখার জন্য বহু দূর-দূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা এসেছিলেন। ক্লাব কর্তৃপক্ষকে ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী পুজো বিগত দুই বছর অতিমারির কারণে বিভিন্ন বিধি-নিষেধের মধ্যে দিয়ে হয়েছিল। এ বছরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় সেইসব বিধি-নিষেধ না থাকায় পুজো উদ্যোক্তারা আবার পুরনো ছন্দে ফেরার জন্য মরিয়া প্রয়াস করেন। এবছরের জগদ্ধাত্রী পুজোয় নিত্যনতুন থিম, লাইটিং শো দেখতে পাওয়া যায়। ক্লাব প্রতিভার সদস্যরা পুজোর বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী নির্মাণ করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। কৃষ্ণনগরের সন্ধ্যারামনগর এলাকায় ক্লাব প্রতিভার মাঠে নির্মিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী।
এবছর তাদের ক্লাবের জগদ্ধাত্রী পুজো ৪৩তম বর্ষে পদার্পণ করল। এবছর তাদের প্রতিমার উচ্চতা প্রায় ৫২ ফুট। আর রয়েছে প্রায় ১২ ফুটের মুকুট। সব মিলিয়ে প্রায় ৬৪ ফুটের জগদ্ধাত্রী। তাদের পুজোর বাজেট ছিল প্রায় ১৩ লক্ষ টাকা, যার মধ্যে প্রতিমা নির্মাণেই তারা সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। মৃৎশিল্পী রমেশ পালের নেতৃত্বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী প্রতিমাটি তৈরি হয়েছে। প্রায় দেড় মাস ধরে তিনি ১৮ জন সহযোগীকে নিয়ে প্রতিমাটি তৈরি করছেন।
এত বড় প্রতিমা তৈরি করতে তাদের রীতিমতো বেগ পেতে হয়। কাজটি খুব একটা সহজ ছিল না। অত উচ্চতায় বাতাসের তীব্রতার জন্য প্রতিমা শিল্পীদের কাজ করতে বেশ অসুবিধা হয়। শুধু বড় প্রতিমাই নয়, প্রতিমার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বড় প্যান্ডেলও করতে হয়। এত বড় প্রতিমাকে মাটিতে দাঁড় করানোও তাদের কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তাই প্রথমে প্রায় ৬০ ফুটের একটি কদমগাছ মাটিতে পুঁতে নিয়ে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। সেই গাছের সাথে প্রতিমার কাঠামোটি বেঁধে নেওয়ার কারণে ভিত্তিটি মজবুত হয়।
২০১৮ সাল থেকেই ক্লাব প্রতিভা বড় জগদ্ধাত্রী প্রতিমা নির্মাণ শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণনগরের ঐতিহ্য জগদ্ধাত্রী পুজোয় দর্শনার্থীদের নতুন কিছু দেখানো। ২০২০ এবং ২০২১ সালে অতিমারির কারণে তারা বৃহৎ জগদ্ধাত্রী গড়তে পারেননি। ২০২২ সালে তারা আবার ফিরে এসেছেন বড় জগদ্ধাত্রী নিয়ে। তবে শুধু বৃহৎ নয়, এবছর তারা নির্মাণ করেছেন বিশ্বের সর্ববৃহৎ জগদ্ধাত্রী।
প্রতিমাটি নির্মাণের সময় ৭০০ টিরও বেশি বাঁশ লেগেছে। এক কুইন্টালের কাছাকাছি দড়ি লেগেছে। প্রতিমাটি নির্মাণ করতে প্রায় ২৮ কাহন খড় এবং ১৫ ট্রাক্টর মাটি লেগেছে। দীর্ঘদেহী এই জগদ্ধাত্রী প্রতিমার শরীর জুড়ে রয়েছে কৃষ্ণনগরের বিখ্যাত ডাকের সাজ। আর জগদ্ধাত্রীর মাথায় রয়েছে প্রায় ১২ ফুটের বিশাল একটি মুকুট।
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।