মতামত

আমার দেখা মহাশ্বেতা দেবী

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

Mahasweta Devi : আমার দেখা মহাশ্বেতা দেবী - West Bengal News 24

আজ লেখার শুরুতে এ কথাগুলো না বলে গেলে লেখার্টি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।প্রতিটি মানুষ যত বড় হয়েছে তার পিছনের ইতিহাস ততটাই অপমানিত ,লাঞ্ছনা, গঞ্জনা । আর এর হাত থেকে রেহাই পায়নি তৎকালীন যুগের মনীষী ও সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবীরা।আর সেই কারণে আমার মত একটা ছাপোষা লেখক এই সমাজের বুকে সবচেয়ে বেশী অপমানিত, অত্যাচারিত ,অবহেলিত ও লাঞ্ছনার শিকার। রাজনৈতিক নেতারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মিথ্যা মামলায় দিয়ে জেল খাটিয়েছিল আমাকে। আমার কলম কে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল, সে চেষ্টা সফল হয়নি রাজনৈতিক নেতাদের। কোনো কিছুতেই আমি পিছপা হইনি ,ভয়ও পাইনি ,আছো লিখে চলেছি। সেই থেকে অপমানিত, লাঞ্ছনা, গঞ্জনা ,অত্যাচার-অবিচার একইভাবে সইছি। সবকিছু যেন আজও আমাকে পিছু তাড়া করে নিয়ে যাচ্ছে, এখনো পর্যন্ত অত্যাচার, অবিচার আর অপমান অব্যাহত। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় তেমন কিছু নেই।আর যাইহোক এসব নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার বিন্দুমাত্র নেই,আজ আমার লেখার বিষয়বস্তু মহাশ্বেতা দেবী কে নিয়ে।

লেখাটি শুরুর আগে আমার বারবার স্মৃতিচারণ হচ্ছে মহাশ্বেতা দেবীর সন্ধিক্ষণে আসার কথা গুলো ।সালটি ছিল ২০০৮ সেই সময় আমার লেখালেখি কারণে রাজনৈতিকভাবে আমার সপরিবারের উপরে অত্যাচার অবিচার এবং আমাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিল রাজনৈতিক নেতাদের একাংশ।এই অত্যাচারের কথা বিভিন্ন ছোট-বড় পত্রপত্রিকায় সেসময় প্রকাশ হয়েছিল।আদিবাসী সংবাদ নামে একটি পত্রিকায় আমার অত্যাচারের খবর প্রকাশ হওয়ার পরে, মহেশ্বতা দেবীর নিজে থেকেই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।শুধু মহেশ্বতা দেবী নন তৎকালীন পুলিশ সুপার অজয় রানাডে সাহেব আমাকে একই রকম ভাবে সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।আমি যতদিন জীবিত থাকব এদের কথা কোনদিন ভুলিতে পারবোনা।তবে আমি আরেকটি মানুষের সন্ধিক্ষণে এসেছেন তিনি হচ্ছেন লিপি পত্রিকার বার্তা সম্পাদক দেবাংশু চক্রবর্তী।তিনি যেভাবে আমার দুঃখ-দুর্দশার পাশে অর্থনৈতিক সাহায্য করেছেন এ কথাটি না লিখে থাকতে পারলাম না এই লেখাতেই।শুরুতে বলেছি এসব নিয়ে আমার লেখার বিষয়বস্তু নয়। আজ সারা বিশ্বের ইতিহাসে মহান তিনি, তিনি হচ্ছেন মহাশ্বেতা দেবী।দেবীর বাড়ীতে থাকার সুযোগ, এই হতভাগ্য লেখোকের হয়েছিল। মহেশ্বরা দেবীর সন্ধিক্ষণে এসেছে, যতোটুকু তার সম্পর্কে আমি অনুভব করতে পেরেছিলাম ও তার নিয়ে পড়াশোনা করে যে সব তথ্য আমি জানতে পেরেছিলাম আজ তার পরিবেশন করছি।বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে বাংলা তথা ভারতীয় সাহিত্যে  আলোচিত নাম মহাশ্বেতা দেবী। ‘নাম’-ই বা কেন, একটি প্রতিষ্ঠান- সমাজসেবা ও সাহিত্যকর্মের যুগল মিলনকেন্দ্র হয়ে উঠেছেন যেন তিনি। যা বাংলা সাহিত্যে অনন্য, ভারতীয় সাহিত্যে দুর্লভ, বিশ্বসাহিত্যেও সুলভ নয় বলেই অনেক সমালোচক মনে করে থাকেন | বাংলা সাহিত্যে বিষয়ের বহুমাত্রিকতা ও দেশজ আখ্যানের অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন মহাশ্বেতা দেবী।তবে তার জন্মের ইতিহাস যতোটুকু আমি জেনেছি ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় জন্মগ্রহণ করলেও তাঁদের আদি বাসস্থান, আদি পিতৃভূমি । যদিও যমুনার করাল গ্রাসে পাবনার বেড়া উপজেলার (তৎকালীন মথুরা থানা) ভারেঙ্গার সেই গ্রাম আজ কেবলি স্মৃতি, অতীত ইতিহাস।

আজীবন সংগ্রামী সর্বজনশ্রদ্ধেয়া এই লেখিকা তথা সমাজকর্মী ৯০ বছর বয়সে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই আমাদের মাঝ থেকে অজানালোকে চলে গেছেন। রেখে গেছেন অমর সৃষ্টি, মানবসেবার মহতী স্মৃতিচিহৃ।উনি আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে, বহুকষ্ট বেদনায় লুকিয়ে রেখেছি আমার হৃদয়ে। আমার দুঃখ দুর্দশা জানান মতন তো আর কেউ নেই,তবে আমার স ব দুঃখ-দুর্দশার আজ নিরসন ঘটিয়েছে দেবাংশু চক্রবর্তী।যাক এসব দুঃখ-কষ্টের কথা, ফিরে আসি মহেশ্বতা দেবীর জীবনের ইতিহাসের কথাতে।মহাশ্বেতার মানসে তাঁর সমগ্র পিতৃ ও মাতৃকুলের পরিবারের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্য-চর্চা নিবিড়ভাবে কার্যকর ছিল। তাঁর পিতামহ সুরেশচন্দ্র ঘটক ইংরেজি ও ইতিহাস বিষয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে ডবল এমএ পাশ করেন। পরে বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে এসডিও হন। তাঁর আদি বাড়ি ছিল পাবনা জেলার পুরনো ভারেঙ্গায়। পিতামহী ইন্দুবালা দেবীও ছিলেন সে-সময়ের শিক্ষিত এবং প্রবল সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিত্ব। এ দম্পতির পাঁচ পুত্র ও চার কন্যা – মণীশ, সুধীশ, তপতী, সম্প্রীতি, ব্রততী, আশীষ, লোকেশ, ঋত্বিক ও প্রতীতি। এঁরা প্রত্যেকেই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে স্বনামধন্য। মণীশ ঘটক কবি ও কথাসাহিত্যিক। সুধীশ ঘটক লন্ডনে সিনেমাটোগ্রাফি শিখে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করেন এবং ক্যামেরাম্যান হিসেবেও খ্যাতি পান। আশীষ ঘটকের পরিচিতি ঘটে সংগীত-অনুরাগী রূপে। লোকেশ ঘটক নাবিক ও ভ্রমণপিপাসু – সেইসঙ্গে প্রবন্ধকার ও অনুবাদক হিসেবেও পরিচিত। ঋত্বিক ঘটক গল্পকার হলেও অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্র-নির্মাতা হিসেবেই সমগ্র বাংলায় খ্যাত। মেয়েরা সকলেই সংগীত-সাহিত্য অনুরাগী। অর্থ-বিত্ত নয়, মেধা-মননের মাপকাঠিতে এ-দুই পরিবার ধনী ছিল নিঃসন্দেহে। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিচারণাতেও এ-দুই পরিবারের সাহিত্যচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়। দুই পরিবারেই দেশ-বিদেশের বই পঠিত ও আলোচিত হতো। তবে মহেশ্বতা দেবি ছোটবেলার কাহিনী আজকের যুগের অত্যান্ত বিরলতম।তাঁকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে কলকাতায় ফিরতে হয় অসুস্থ মা ও ছোট পাঁচ ভাইবোনের দেখাশোনা করার জন্য। মাত্র তেরো বছর বয়সে গৃহকর্ত্রীর কঠোর দায়িত্ব তিনি পালন করা শুরু করেন সুচারুভাবে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক ও সাহিত্য পাঠ থাকে অব্যাহত।

১৯৩৯ সালে শান্তিনিকেতন থেকে ফেরার পর তিনি বেলতলা বালিকা বিদ্যালয়ে ক্লাস এইটে ভর্তি হন। এ-সময়ে বন্ধুসম সমবয়সী কাকা ঋত্বিক ঘটকের সান্নিধ্যে তিনি ইংরেজি সাহিত্য পাঠে মনোযোগী হন। দেশ-কালের অস্থিরতা ও বিশ্বসাহিত্যের সংযোগে তাঁর লেখকজীবনের প্রস্ত্ততিপর্ব ধরে নেওয়া যায় সে-সময়কে। এ-সময়ই তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৪০-এ রংমশাল পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ সম্পর্কে লিখেছিলেন তিনি এবং এটি ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত লেখা।তবে একদিন তিনি খাবার টেবিলে বসে আমাকে উৎসাহিত করার জন্য তার ছোটবেলার গল্প শুনিয়েছিলেন।ছোটবেলাতেই লেখাপড়ার জন্য তাঁর কলকাতা চলে যাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি ঢাকাতে কোনদিন লেখাপড়া করিনি। কারণ বাবার বদলির চাকুরি। বাবা যখন যেখানে তখন সেখানে পড়েছি। আমাকে দশ বছর বয়সে শান্তিনিকেতনেই পাঠিয়ে দেন। ১৯৩৬ সালে আমি শান্তিনিকেতনে পড়তে যাই। যখন রবীন্দ্রনাথ জীবিত এবং খুবই সক্রিয়। সেই সময় চিত্রাঙ্গদা, চন্ডালিকা, তাসের দেশ এই সমস্ত তিনি রচনা করছেন। আমরা সেই সব দেখেছি। সেই সব শুনেছি। তাঁকে আমরা খুব কাছে পেয়েছি। সেই সব অভিজ্ঞতা লেখক-জীবনকে প্রভাবিত করেছে। না রবীন্দ্রনাথকে শুধু আমার লেখক জীবন বলে না, তাঁকে তো মনের মধ্যে বহন করে নিয়েছি। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথকে দেখার-জানার অভিজ্ঞতা তো এক জায়গায় শেষ হয় না।’মহেশ্বতা দেবীর এসব কথাগুলো আজ আমার কানে বাজে।সেই সময়ে আমি আদিবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি  করেছিলাম এবং সুন্দরবনের আদিবাসী গবেষণার পাঠ শুরু করে  ছিলাম।তিনি আমার কাছ থেকে বহু আদিবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করতেন, তার লেখনীতে আদিবাসীদের উপন্যাস ফুটিয়ে তুলেছে।তেমনি উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী ভূমিলগ্ন-আদিবাসীর জীবন আখ্যানকে এমনভাবে তুলে এনেছেন যা মূলত হাজার বছরের ভারতীয় প্রান্তিক আদিমজনের জীবন-সংস্কৃতিরই সাক্ষ্যবাহী। যা বাংলা উপন্যাসকেও নতুন আঙ্গিকে সমৃদ্ধ করেছে।  তার মতো সাহিত্যিক বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন।মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাসে অসংখ্য বীরের কাহিনী তুলে এনেছেন। এই বীরের কাহিনী শুধু বীরসা চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এছাড়াও আরও বীর চরিত্র আমরা পেয়েছি। যেমন— চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর-এর চোট্টি একজন বীর তীরন্দাজ। সুরজ গাগরাই-এর সুরজ চরিত্রটিতেও বীরের উপস্থিতি দেখতে পাই। মহাশ্বেতা দেবী লেখাকে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় নিয়ে গেছেন।

তার উপন্যাস বেশিরভাগই সময়ের দলিল হয়ে পৌঁছে যাবে ভবিষ্যতের দিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় অরণ্যের অধিকার উপন্যাসটি। এ ক্ষেত্রে মহাশ্বেতা গ্রন্থটির ভূমিকায় বলেছেন— এ উপন্যাস রচনায় সুরেশ সিং রচিত Dust storm and Hanging mist বইটির কাছে আমি সবিশেষ ঋণী। সুলিখিত তথ্যপূর্ণ গ্রন্থটি ছাড়া বর্তমান উপন্যাস রচনা সম্ভব হতো না। সুরেশ সিং-এর বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। মহাশ্বেতা তার অরণ্যের অধিকার রচনা প্রকাশিত হয় ১৯৭৫ সালে। কিন্তু সুরেশ সিং-এর বই দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। Birsa Munda and His Movement-১৮৭৪-১৯০১ নামে। ইতিহাস-গবেষণা ও উপন্যাস রচনার এমন পারস্পরিক সমন্বয় খুব একটা ঘটে না। এ থেকে বলা যায় যে, মহাশ্বেতা দেবী ইতিহাস থেকে এমন চরিত্র নির্মাণ করেন, যা নিজেই ইতিহাস হয়ে যায়।

তবে তার জীবনের ব্যক্তিগত ইতিহাস না লিখলে হয়তো লেখা টি অসম্পূর্ণ হয়ে যাবে।প্রখ্যাত নাট্যকার ও সাহিত্যিক বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে পারিবারিকভাবে তাঁর বিয়ে হয় ১০ ফেব্রম্নয়ারি ১৯৪৭ সালে। সে-সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে বিজন ভট্টাচার্য কোনো অর্থনৈতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সংসার চালানোর পুরো দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মহাশ্বেতা ১৯৪৮ সালে পদ্মপুকুর ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। জীবিকার তাগিদে তিনি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হন; যথেষ্ট সংগ্রামসংকুল ছিল তাঁর কর্মজীবন। ১৯৪৯ সালে ইনকাম ট্যাক্সের অফিসে চাকরি পেলেও তা করা হয়নি, বড় অফিসার বাবা মণীশ ঘটকের কন্যার কেরানি পদে যোগ দেওয়া সামাজিকভাবে নিন্দনীয় বলে। এ-বছরই তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের পোস্টাল অডিটে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে চাকরি পান; কিন্তু এক বছরের মধ্যেই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয় রাজনৈতিক সন্দেহের বশবর্তী হয়ে বা স্বামী কমিউনিস্ট হওয়ার অপরাধে।

প্রখ্যাত আইনবিদ অতুল গুপ্তের চেষ্টায় অস্থায়ীভাবে পুনর্বহাল হলেও ১৯৫০-এ তাঁর ড্রয়ারে মার্কস ও লেনিনের বই পাওয়ার অপরাধে তাঁকে দ্বিতীয়বার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এরপর আর সরকারি চাকরিতে ফেরার চেষ্টা করেননি তিনি।মহেশ্বতা দেবীর মতো ব্যক্তিত্ব কে অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তিনি কোনভাবে কারোর কাছে মাথা নত করেননি। প্রথম থেকেই  ত্যাগ ছিল তার জীবনে অপরিসীম কার্য।সেই কারণে তাঁর লেখাতে ফুটে উঠেছিল বিভিন্ন আন্দোলনের চারিত্রিক উপন্যাস। যেমন নকশালবাড়ি আন্দোলনকে নিয়ে তাঁর লেখা ‘হাজার চুরাশির মা’ আমার মতো অনেকেরই খুব প্রিয় একটা উপন্যাস। সেটি নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি লিখেছি একটা উচ্চবিত্ত ঘরেরই নারীর কথা; হাজার চুরাশির মা লেখার পর কত মা আমাকে বলেছেন যে, এ তো আমার ছেলের গল্প। আপনি লিখলেন কী করে! তার মানে এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই, তখন কিন্তু কলকাতাতেই বেশি দেখেছি, পশ্চিমবাংলায় অন্যত্রও হয়েছে। কীভাবে ছেলেরা নিহত হয়েছে। এবং বহু ছেলের নাম, ছেলে না হয়ে নম্বর হয়ে গিয়েছিল।

এই এক, দুই, তিন-চার করে আসছে যখন এখানে পৌঁছাবে তখন, আপনার ছেলের নাম হয়ত এখানে আছে। এটা আমি শুনেছিলাম। সুজাতা নামটা এরকম যে-কোন উচ্চবিত্ত ঘরের নারী, মানে মায়ের কথা। মানুষটা আর মানুষ থাকে না, নম্বর হয়ে যায়। ওতো নম্বর হয়ে গিয়েছিল। নম্বর এলেই বলতে পারবো তার কী হয়েছে। সেই সময় আরেকটি খুব প্রিয় বই চোট্টিমুন্ডা সম্পর্কে তিনি বলেছেন- চোট্টিমুন্ডা সম্পর্কে বলতে তো খুব ভাল লাগে এই জন্য, যে আমার লেখার এনার্জি, দম সব কিছুই খুব বেশি ছিল। মহাশ্বেতা দেবীর মুখ থেকে শোনা এসব গল্প কথা।‘বিচিত্রা’ নামের আর একটি কাগজে বেরিয়েছিল নাকি। চোট্টিমুন্ডা খুব গুরুত্বপূর্ণ বই। আর আশ্চর্য হচ্ছে চোট্টি লোকটিকে আমি দেখিনি। একজন দায়িত্ববান সাহিত্যিক হিসেবে অন্যায়-অবিচার-অনাচারের বিরুদ্ধে ‘সূর্য-সম ক্রোধ’ নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী সমগ্র জীবন ‘মানুষের কথা’ লিখেছেন।

শিল্পের চেয়ে মানবিকতার দাবিকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি সর্বদা; তবে তাতে শিল্প নিষ্প্রাণ হয়নি বরং মানবতার রসে জারিত হয়ে সপ্রাণ হয়েছে। বহুপ্রজ এই লেখক সংখ্যায় নয়, বিষয়বিন্যাস এবং নির্মাণ-কৌশলের অভিনবত্বে বাংলা সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন এবং নিজেকে পরিণত করেছেন এ-অঙ্গনের এক অপরিহার্য ব্যক্তিত্বে। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি মানুষের কাছে নিজেকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছেন এবং যতদিন আদিবাসীরা বেঁচে থাকবে ততদিনই তিনি তাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে মহাশে^তা বেঁচে থাকবেন তাঁর সাহিত্যের মধ্য দিয়ে; তাঁর অগ্নিগর্ভ জীবন ও সৃষ্টি স্মরিত হবে বহুকাল; ভবিষ্যৎকাল হয়তো নতুন মূল্যায়নে নতুন দৃষ্টিকোণে তাঁর সাহিত্যপাঠ করবে – কালের গর্ভে তা হারিয়ে  যাবে না।

আরও পড়ুন ::

Back to top button