বাংলার পট ও পটুয়া হল লোকসংস্কৃতির আলোচনায় দুটি বিশেষ ক্ষেত্র। পটচিত্র যারা আঁকেন তারাই হলেন পটুয়া। ভারতের প্রাচীন লোকশিল্পী ও গণমনোরঞ্জক জনজাতি হল পটুয়ারা। এদের অনেক নাম রয়েছে। যেমন— চিত্রকর, পটুয়া, পটিদার, পটিকার, পাটিকার, মস্করি, কোথাও কোথাও আবার বেদে, বেদিয়া প্রভৃতি। ভারতের প্রাচীন সাহিত্যিক উপাদানগুলিতে পটুয়াদের হরেক নামের উল্লেখ রয়েছে। ‘বৃহৎ বঙ্গ’-তে যেমন পটীদার শ্রেণীর প্রসঙ্গে রয়েছে— “আমরা বুদ্ধের সময় হইতে একদল লোকের সাক্ষাৎ পাই যাহাদের ব্যবসা ছিল ছবি দেখাইয়া লোকের মধ্যে শিক্ষা প্রচার করা। ইহাদিগের উপাধি ছিল মস্করী।”
পটুয়াদের নিয়ে অনেক রোমাঞ্চকর কাহিনী রয়েছে। তাদের জন্ম হল কিভাবে?— এ বিষয়ে যেমন পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। বলা হয়— চিত্রকর সম্প্রদায় দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সন্তান। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মা ও আর্যকন্যা ঘৃতাচীর মিলনে চিত্রকরদের জন্ম হয়। তারা ‘নবশান’ গোষ্ঠীর অন্তর্গত। ঘৃতাচীর গর্ভে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ৯ সন্তানের জন্ম দেন— মালাকার, কর্মকার, কাংস্যকার, শঙ্খকার, কুম্ভকার, তন্তুবায়, সূত্রধর, স্বর্ণকার ও চিত্রকর। সুতরাং চিত্রকররা হলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার সন্তান।
পটুয়া চিত্রকরেরা ভারতের বহু পুরনো জনজাতি। এদের একদা গুপ্তচর বৃত্তিতেও লাগানো হত। এরা কৌতুক রস উদ্রেককারী হিসেবেও কাজ করতেন। পটুয়ারা না হিন্দু, না মুসলমান। হ্যাঁ, অবাক হতে হলেও এটাই সত্য। তাদের ধর্মীয় জীবনে, আচার-আচরণে হিন্দু সমাজ, মুসলমান সমাজ, এমনকি উপজাতীয় সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে।
এককথায় পটুয়া চিত্রকরদের ধর্মীয় পরিচয়টি কুয়াশাচ্ছন্ন এবং বিতর্কিতও বটে। অতীতে বাংলার পটুয়া শিল্পীদের পরিচয় পাওয়া যায় বৌদ্ধধর্ম ও বুদ্ধদেবের জাতক জীবন কাহিনী প্রচারের ক্ষেত্রে। মধ্যযুগের বাংলায় পাল রাজাদের শাসনকালে চিত্রকরেরা নাকি তাদের আঁকা চিত্র দেখিয়ে জনমানসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার, প্রসারের কাজ করতেন। গ্রাম বাংলায় পটুয়াদের পটচিত্রের প্রদর্শন ছিল বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। পটুয়ারা ছিলেন গণমনোরঞ্জক, আবার লোকশিক্ষক।
সমাজে পটুয়াদের দোদুল্যমান অবস্থার পশ্চাতে নির্দিষ্ট কিছু কারণ রয়েছে। বাংলায় সেন বংশের শাসনকালে শাস্ত্রবিরোধী চিত্র আঁকার জন্য পটুয়াদের সমাজচ্যুত হতে হয়েছিল। ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা তাদের হিন্দু সমাজ থেকে বহিষ্কৃত করেন। তখন পটুয়ারা ইসলাম ধর্মের দিকে ঝোঁকেন। তবে সেখানেও তারা উপযুক্ত মর্যাদা পাননি। কারণ ইসলামে তো চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ, আর পটুয়ারা হলেন চিত্রশিল্পী— এটাই তাদের জীবিকা। ইসলাম আবার পৌত্তলিকতারও বিরোধিতা করে। তাই ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর থেকে পটুয়ারা ইসলাম ধর্মকেন্দ্রিক চিত্র আঁকতে শুরু করেন। সেই থেকে শুরু হয় চিত্রকরদের গাজি পট আঁকা ও গাজি পটের গান রচনা।
এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, পটুয়া চিত্রকরদের ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনের সাথে সাথে, বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার-প্রসার, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রচার-প্রসার, এমনকি ইসলাম ধর্মেরও প্রচার-প্রসারে তাদের কাজে লাগানো হয়েছে। আর ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীবিকার ধরন এবং জীবনচর্যার চরিত্রে উল্লেখনীয় পরিবর্তন আসে, যা আজও তারা বহন করে চলেছে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, নদিয়া