কৃষ্ণনগরের ‘রানিকুঠি’ — নদিয়া-রাজের মহারানী এই বাড়িটি ক্রয় করেছিলেন, সেই থেকেই ভবনটির নাম লোকমুখে হয় ‘রানিকুঠি’। তখন নদিয়া-রাজের মহারানী ছিলেন জ্যোতির্ময়ী দেবী। বিংশ শতকের প্রথমার্ধের ঘটনা সেটি। যদিও এই ভবনটির অতীত আরো বেশি সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বহন করছে। উনিশ শতকের কথা বলা হচ্ছে। তখন এটি ছিল বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেবক-পরিবার চৌধুরীদের বাড়ি। এই বাড়িরই সুসন্তান ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী, যিনি হলেন বাংলা সাহিত্যের ‘বীরবল’। বিশ্ববরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে বহু গুণী মানুষের পদধূলি এই বাড়িটিতে পড়েছে।
এহেন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বহন করে চলা কৃষ্ণনগরের চৌধুরী পরিবারের বসতভিটে ‘রানিকুঠি’ আজ জরাজীর্ণ। আর কয়েক বছরের মধ্যেই হয়তো এর অস্তিত্ব বিলীন হবে! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, আশুতোষ চৌধুরী, প্রসন্নময়ী দেবী, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রামতনু লাহিড়ীর মতো বহু মনীষীর স্মৃতি বিজড়িত এই রানিকুঠি দেখা থেকে আগামী প্রজন্মকে বঞ্চিত হতে হবে— এই ভবিষ্যৎবাণী এমতাবস্থায় করাই যায়।
‘রানিকুঠি’ নামকরণের আগে থেকেই এই ভবন এক সমৃদ্ধ ইতিহাস বহন করে চলেছে। একদা এটি ছিল কৃষ্ণনগরের হোয়াইট টাউন এলাকা। সেখানকার এক শ্বেতাঙ্গ সাহেবের বাড়ি ছিল এটি। অতঃপর দূর্গাদাস চৌধুরী ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কৃষ্ণনগরে আসেন এবং তার সন্তানদের পড়াশোনার সুবিধার জন্য এই বাড়িটি ক্রয় করেন। দূর্গাদাস চৌধুরীর সন্তান ছিলেন যথাক্রমে আশুতোষ চৌধুরী, কুমুদনাথ চৌধুরী, প্রমথ চৌধুরী এবং প্রসন্নময়ী দেবী। তখন এটি ছিল চৌধুরী পরিবারের বাড়ি, রানিকুঠি নামকরণ তখনও হয়নি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রামতনু লাহিড়ী, কালীচরণ লাহিড়ী, অতুলপ্রসাদ সেনের মতো বহু জ্ঞানীগুণী ব্যক্তির আগমন ঘটেছিল এই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এখানে এসেছিলেন এবং কয়েক দিন ছিলেন বলেও শোনা যায়। একদা জাহাজ যাত্রাকালে চৌধুরী পরিবারের আশুতোষ চৌধুরীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সখ্যতা হয়েছিল। সেই সূত্র ধরেই ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫শে এপ্রিল ইস্টারের ছুটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাই হেমেন্দ্রনাথের কন্যা প্রতিভার সম্বন্ধ নিয়ে কৃষ্ণনগরের এই চৌধুরী বাড়িতে আসেন। বিংশ শতকের প্রথমার্ধে নদিয়া রাজবংশের মহারানি জ্যোতির্ময়ী দেবী এই বাড়িটি ক্রয় করেন। তারপর থেকেই বাড়িটির নাম হয় ‘রানিকুঠি’।
কৃষ্ণনগরের ডনবক্স রোডে গেলে মেরি ইমাকুলেট হাসপাতালের ঠিক পাশেই ‘রানিকুঠি’ ভবনটিকে দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখতে পাওয়া যাবে। বর্তমানে এর ভগ্নপ্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা যেকোনো সংস্কৃতি সচেতন মানুষকেই পীড়া দেবে। এত সমৃদ্ধ যার ইতিহাস, সেই কৃষ্ণনগর তার ঐতিহাসিক স্মারক সংরক্ষণের বিষয়ে কতটা যে উদাসীন, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল এই রানিকুঠি।
যদিও ২০১৮ সালে ওয়েস্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন কৃষ্ণনগরের রানিকুঠিকে একটি হেরিটেজ ভবনের স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু হেরিটেজ ঘোষণার পরেও, রানিকুঠির সংস্কার করা হয় নি। অদ্ভুত এক উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাক-অতিমারি পর্যায়ের বছরগুলিতে কখনো কখনো সাধারণ জনগণের মধ্যে থেকে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার চিন্তাভাবনা করা হলেও সেগুলি খুব একটা ফলপ্রসু হয়নি। যত দিন যাচ্ছে রানিকুঠির স্বাস্থ্য ততোই ভেঙে পড়ছে। সরকার থেকে জনগণ —সকলেই যেন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনে অবিচল।
লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।