নদীয়া

দোগাছির লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা

দীপাঞ্জন দে

দোগাছির লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা

কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানার অন্তর্গত ‘দোগাছি’ বা ‘দোগাছিয়া’ গ্রামের লক্ষ্মীপুজো কালের নিরীখে একটি বিশেষ উৎসবে পরিণত হয়েছে। বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ফিবছর দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজো দেখতে আসেন। দোগাছি পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ৩০টিরও বেশি গ্রাম রয়েছে। ৪০ হাজারেরও বেশি মানুষের বসবাস সেখানে। সেখানে গ্রামবাসীরা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো ভক্তিভরে করেন।

স্কুলগুলিতে এবং কয়েকটি পাড়ায় স্বতন্ত্রভাবে সরস্বতী পুজো হয়। প্রতিবছর চড়কের সময় গ্রামে বিশেষ উৎসাহ দেখতে পাওয়া যায়। আবার সংখ্যায় একেবারেই কম হলেও দোগাছি গ্রামে জগদ্ধাত্রী পুজোও হয়। তবে সবকিছুকে অতিক্রম করে যায় দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর উন্মাদনা। এই গ্রামের লক্ষ্মীপুজো বিশেষ ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। গ্রামের ঘরে ঘরে লক্ষ্মীপুজোর আলপনা দেওয়া হয়।

সেখানেও এক শিল্পবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। ইদানিংকালে দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজো দেখার পাশাপাশি মানুষজন দোগাছি গ্রামের বাড়িগুলিতেও যান সেই আলপনা দেখতে। লক্ষ্মীপুজোকে কেন্দ্র করে এখন এমনই উন্মাদনা তৈরি হয়েছে যে, পুজোর সময় গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি তাদের আত্মীয়-স্বজন, কুটুমে ভরে যায়।

দোগাছির লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা

দোগাছি বা দোগাছিয়া গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর সব থেকে বড় বড় আকর্ষণ হল এই পুজোকে কেন্দ্র করে বসা মেলা। দোগাছি গ্রামের বাসিন্দাদের আশেপাশের মানুষেরা ‘দোগেছে’ বলে থাকেন। সেই দোগেছেদের কাছে এই মেলা ‘লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা’ বা ‘আড়ং মেলা’ নামেই পরিচিত। ‘আড়ং’ শব্দটির অর্থ হল— প্রতিমা বিসর্জন উপলক্ষে নদী তীরের সাময়িক বাজার। আর দোগাছি গ্রামটি অঞ্জনা নদীর তীরেই অবস্থিত।

একপ্রকার মেলা প্রাঙ্গণের অনতিদূরেই অঞ্জনার নদীখাত। দোগাছি হাইস্কুলের পূর্ব দিকে সোসাইটির মাঠকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর এই মেলা বসে। স্কুলের উত্তর দিক দিয়ে বয়ে গেছে অঞ্জনা। কাছেই দোগাছি বাজার। প্রায় ৩০ বছর ধরে স্কুলের পাশে এই মাঠটিতে মেলা বসছে।

তার আগে ইছাপুর গ্রামে আড়ং বসত। কোভিডের কারণে দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা দুই বছর বন্ধ ছিল। সকলেরই তাই মন খারাপ ছিল। দোগাছি গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুষেরা অধির আগ্রহে মেলার প্রতীক্ষায় ছিলেন। ২০২২ সালের মেলা ঘিরে তাই যেন উৎসাহ উন্মাদনা অন্য মাত্রা পেল।

দোগাছির লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলা

দোগাছি গ্রামের লক্ষ্মীপুজোর ভাসান মেলায় ঘরের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে খাবার দাবারের দোকান, হরেক মাল, নাগরদোলা সহ বিভিন্ন খেলা, ফুচকা, আইসক্রিম, পাঁপড় ভাজা, শরবত সবকিছুর দোকানই দেখতে পাওয়া যায়। মাঠের ভিতরে তো বটেই, মাঠের সামনের এবং পাশের রাস্তার দুধারে ছোট ছোট দোকানীরা নিজেদের অস্থায়ী দোকান সাজিয়ে বসে পড়েন। সারারাত ধরে মেলা চলে। মেলার ভিড় কিছুতেই কমে না।

স্থানীয়দের কথায় যত রাত হয় ততোই নাকি মেলা জমে ওঠে। জমবে নাই বা কেন? রাত বাড়ার সাথে সাথে গ্রামের ক্লাব, বারোয়ারিগুলি তাদের লক্ষ্মী প্রতিমাগুলি ভাসানের জন্য একে একে মাঠে আনতে থাকেন। স্কুলের মাঠ এবং আশেপাশের রাস্তায় সে সময় গিজগিজ করে মানুষ। এর জন্যই এটি ভাসান মেলা বা আড়ং মেলা নামে পরিচিত।

লক্ষ্মী প্রতিমাগুলিকে তারপর পাশ দিয়েই বয়ে চলা অঞ্জনা নদীতে ভাসান দেওয়া হয়। সে সময় গ্রামবাসীদের উন্মাদনা যেন চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। এই পর্বের সমাপ্তি হতে হতে রাত গড়িয়ে আকাশে সূর্য উঁকি দেয়, ভোর হয়।

লেখক: অধ্যাপক, চাপড়া বাঙ্গালঝি মহাবিদ্যালয়, নদিয়া।

আরও পড়ুন ::

Back to top button