বিষ-বৃষ্টি
এ কে সরকার শাওন
বাহিরে বৃষ্টির শব্দ।
তুমি জানালার পর্দাটা
দু’হাতে দু’দিকে সরিয়ে,
একটি অপূর্ব “হি হি”
হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে,
অপরূপ গ্রীবাদেশ বাকিয়ে,
ডান হাতে মুখের সামনের
চুলগুলি সরিয়ে,
শোনালে একটি অমিয় বাণী
“দারুন না!”
আমি বলেছিলাম, “কোনটা?
তুমি না বৃষ্টির রিমঝিম?”
একটি অপূর্ব ঠমক দিয়ে বললে,
“দু’টোই!”
আমি বলেছিলাম, “তুমিই বেশী,
দু’টো নয় মোটেই”!
সেই কবেকার কথা!
আজ ঘূর্ণিঝড় ‘টিতলী’র প্রভাবে
এখানে বৃষ্টি ঝরছে অঝোর ধারায়
রিমঝিম শব্দে সবাই বিমোহিত হয়।
আমার মনে ঝড় বয়ে
সব লন্ড-ভন্ড হয়;
যেমনটা হচ্ছে এখন
ভারতের উপকূলীয় ঊড়িষ্যায়,
কেহ জানতে না পায়।
সবার কাছে বৃষ্টির সুর
একই সুর নয়
কারো কাছে “দারুন না”
কারো কাছে “বিষময়”।
সময়ভেদে তা ভিন্ন ভিন্ন হয়!
———————————-
বৃষ্টি বিলাপ
এ কে সরকার শাওন
জন্মদিনের শুভ লগ্নে
মা মনির বিদায় ক্ষণে।
অন্তরে অতুষ্টি বিকৃষ্ট বৃষ্টি
বিষজ্বালা সবার মনে।
দুঃখ ঢেকে পরিপাটি পোষাকে
আলো ছড়ায় চাঁদমুখে।
অন্তরে রোদন বিমূর্ত ক্রন্দন
দুঃখের উত্তাপ বুকে!
অঝোর ধারায় ভারী বর্ষায়
পথ ঘাট টুইটুম্বর।
সর্পিল বাঁকা রাস্তা ফাঁকা
রাতের প্রথম প্রহর!
সেই ক্ষণে বিষণ্ণ মনে
মা মনি প্রস্তুত সফরে।
যাবে সুদূরে ভুবনেশ্বরে
ছাত্রত্বের নিরস খাতিরে!
দৃঢ় মনোবল চোখ ছলছল
হাসির রেখা ঠোঁটে।
অন্তর অচল তবু অবিচল
সন্মুখে চলছে ডাটে!
বাবা-মা পরিজন বন্ধু-স্বজন
সাথে চলছে তার।
শত শর বিঁধেছে পরপর
শোকার্ত অন্তর অসাড়!
বিদায় লগ্নে রেল ষ্টেশনে
বাবার মতই বুঝায়।
“অবুঝের মত হয়ো না বাপি,
দোয়া করো আমায়!”
বাবা মায়ের দোয়া খায়ের
তোমার জন্য বাপি।
মানুষ হও আলো ছড়াও
ঘুচাও যাবৎ তাপী!
হাত নেড়ে জানায় বিদায়
অন্তরাত্মা নড়বড়ে!
চাঁদমুখে আমাবস্যা নামে
বৃষ্টি নামে চোখ জুড়ে!
বৃষ্টি বারি অশ্রুতে মিলায়
ট্রেন মিলায় সুদুরে।
অন্তরে বর্ষায় অঝোর ধারায়
বিবর্ণ বৃষ্টি দু’ধারে।
————————————
বৃষ্টি বিলাস
এ কে সরকার শাওন
তরুচ্ছায়াঘন সন্ধ্যা লগ্ন
আষাঢ়ে আপন আঙ্গিনায়;
উত্তাল বায়ে তান্ডব প্রলয়ে
গায়ে বৃষ্টি আছড়ায়।
বজ্রনাদ আর বজ্রপাত,
চোখ ধাঁধানো আলো;
শত বিজলীর ঝলমলে আলোয়
নিমিষেই নিখোঁজ কালো।
শীতল বায় মন নাচায়
জুড়ায় তাপিত তনুমন।
খুশীর ছোঁয়ায় ভিজে বরিষায়
স্মরণীয় রাখি ক্ষণ।
ভেজা শেষে ঘরে এসে
ভাজভাঙ্গা পাঞ্জাবি পরে;
বাগান ঘেষে বাতায়ন পাশে
বসি বৃষ্টি দর্শনের তরে!
নিবিষ্ট মনে বৃষ্টির সনে
কী নিবিড় মরি মরি!
আষাঢ় মাসে পানি ভাসে,
ভাসে স্মৃতির লুকোচুরি!
স্তব্ধতা ভাঙ্গায় প্রেয়সী বাড়ায়
ধূমায়িত কফির পেয়ালা!
প্রিয়া, বৃষ্টি, কফির ছোঁয়ায়
চুমুকেই মন উতলা!
নন্দে ছন্দে ভাব তরঙ্গে
উচ্ছ্বসিত সিক্ত প্রান!
বাহিরে বজ্র-বৃষ্টি তুফান
উচ্চ শিরে চলমান!
দু-চার চরণ আবৃত্তি, স্মরণ,
গুনগুনিয়ে গাই গান।
এই মুহূর্তে জগলু বাদশাহ
তার জীবন মহীয়ান।
সহসা দৃষ্টি আম্রবৃক্ষে
ভীতসন্ত্রস্ত এক পত্রী!
নিমিষেই উড়ে পেঁপে পত্রে
কাক ভেজা অভিযাত্রী!
ডানা ঝাঁপটায় আশ্রয় চায়
চুপসে সে চুপচাপ।
ঝঞ্ঝা রাতে বিপদে-বিপথে
মুখাবয়বে নাই ছাপ।
বৃষ্টি বিলাস রেখে একপাশ
পাখীর জন্য ভাবনা;
কোথায় বাস? কোথায় আশ?
কোন সুদূরে ঠিকানা?
ঠিকানাবিহীন নিরাপত্তাহীন
উড়ে প্রান্তিক প্রান্তরে।
দুঃখ, হতাশা, অনুযোগ নাই
কোন ক্লেশ নাই অন্তরে!
মানব জীবন পাখীর জীবন
তফাৎ আকাশ পাতাল।
পেয়েও সব আক্ষেপ অনুভব
মানব অকৃতজ্ঞ চিরকাল।
পাখীর জীবন স্বাধীন
নির্মল ভাবলেশহীন!
মানব জীবন আবদ্ধ অধীন
শৃঙ্খলিত সুকঠিন।
—————————————
মালীর অশ্রুজল
এ কে সরকার শাওন
জগলু মালীর অন্তর খালি
কাটখোট্টা অর্বাচীন।
অরণ্যে-রণে, ফুল-কাননে,
উপবনে জীবন বিলীন!
বারিধারায় জলের ছোঁয়ায়
তাতায় বিবাদী মন।
ঝিনুকের মত নিজকে লুকায়ে
ভোলে দুঃখ তাপন!
বৃষ্টিস্নাত পত্র পৃষ্ঠে
ফোটা ফোটা বৃষ্টির জল !
সাথে নীরবে ক’ফোটা ঝরলো
মালীর অশ্রুজল!
অশ্রুর ফোঁটা বৃষ্টির জলে
অনাদরে চির বিলীন!
কেউ জানলো না শোধ হলো কি না
মালীর হৃদয়ের ঋণ!
মালীর চোখে কাজল ছিল না
ছিলো না কোন ছল!
তাইতো জল স্বচ্ছ টলটল
কমলের মত কোমল।
খরতাপে প্রান্তর চৌচির
খা খা নদীর তল্
মালির চোখের দু’কুল ছাপিয়ে
তখনো অশ্রু টলমল!
পত্র পৃষ্ঠের জল শুকায়
উল্লাসে নাচে হাওয়ায়;
পত্রপল্লভ ফুলে শোভিত
বসন্তের মাতাল ছোঁয়ায়!
মালির জীবন তথৈবচ
বসন্ত-বরষায় তমসা!
ফুলের পাশে চির নিবাস
তবু অন্তরে হতাশা!
সেরা ফুলটি মালীর নজরে
হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায়।
কষ্টের শান হবে অবসান
শোভা পেলে প্রিয়ার খোঁপায়।
আজো সে এলো না হেসে
এ প্রতীক্ষার শেষ কোথায়?
যুবক মালী আজ বয়োবৃদ্ধ
অশ্রু থামেনা হায়!
—————————————
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে
সবাই আধো-ঘুমে বা
বেঘোর ঘুমে মরার মত আছে পড়ে,
একাকী জেগে আছি আমি
দ্রুতযান ট্রেনের ভিতরে;
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে।
গভীর নিস্তদ্ধতা চারপাশ জুড়ে,
আমার তনু-মন-চোখ,
হাতড়ে ফিরছে নিরন্তর
স্মৃতির অশেষ সমুদ্রতীরে
শুধুই তাঁরে বারে বারে;
আলো-আঁধারে, ভিতরে-বাহিরে,
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে।
কারো কারো নাক ডাকার শব্দ,
কারো খুক খুক কাশি,
রাতের নিরবতাকে টেনে নিচ্ছে
সময়ের অতল সাগরের গভীরে
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে।
শান্ত সুস্থির নিশ্চুপ নীরব
আকাশের তারামন্ডল,
প্রকৃতি স্থির ঠায় দাড়িয়ে আধাঁরে;
সুনশান নিরবতা চারিদিকে ,
ট্রেনটা বুকফাটা আর্তনাদ করে
মালঞ্চি পার হয়ে ছুটছে
আমার গন্তেব্যে শেষ প্রান্তে;
প্রিয় শহর নাটোর অনতিদূরে…
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে।
চিরচেনা প্রিয় এই শহরে,
আবার এসেছি ঘুরে ফিরে,
খুজিঁতে হারিয়ে যাওয়া
সেই তো সেই প্রেয়সী সজনীকে
যাকে হারিয়েছি আমি চিরতরে
শ্রাবণের রাত্রি ত্রিপ্রহরে।
এ কে সরকার শাওন।
কবি পরিচিতিঃ
কবি এ কে সরকার শাওন ১৯৬৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাধীন নবীনগরের গোপালপুর গ্রামের সরকার বাড়িতে জন্মগ্রহন করেন। পিতা মো: আবদুল গনি সরকার একজন সরকারী কর্মকর্তা এবং মাতা মিসেস সালেহা গনি সরকার একজন আদর্শ গৃহিনী ছিলেন।
শিক্ষা জীবনের শুরু ঝালকাঠির উদ্ধোধন হাই স্কুলে। ১৯৮৩ সালে নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি, ১৯৮৫ সালে নবীনগর সরকারী কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাশ করেন। ১৯৯১ সালে বিমান বাহিনীর এ্যারোনটিক্যাল ইন্জিনিয়ার্ং ইনসটিটিউট (ATI) থেকে প্রথম শ্রেণিতে এসোসিয়েট ইন্জিনিয়ারিং পাশ করেন। ১৯৯৬ সাল থেকে ১০ বছর ঐ ইনসটিটিউটের প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্য স্নাতক, ২০০৭ সালে এজাম্পশন বিশ্ববিদ্যালয়, থাইল্যান্ড থেকে ডিপ্লোমা ইন ইনফরমেশন টেকনোলজিতে স্নাতক লাভ করেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি আইনে স্নাতক।
কর্ম জীবনের এক পর্যায়ে তিনি নাটোরে প্রান কোম্পানির শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মূলত সেখান থেকেই তাঁর কবিতার স্ফুরণ হয়। তুমি আমার সজনী সেন, পরে কথা হবে, আমি নইকো একেলা, রাজসিক নাটোর, দাগ রয়ে যায়, চশমা, বিরাগ বচনের মত পাঠক প্রিয় কবিতা উপহার দেন সেখান থেকেই। কবির আর যেসব কবিতাগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ না করলেই নয় তা হলো, নারী তুমি অনন্য, শিকড় শিখর, কাচাল, ধন্যি মেয়ে, বাবার ছবি, শারদ সন্ধ্যায়, অভিসারী আশ্বিন, হেমন্তের গান ইত্যাদি।
তিনি ও তার সহধর্মীনি শিক্ষাবিদ নাজমা আশেকীন শাওন এম. এ. এম-এড তিন গর্বিত কন্যা সন্তানের জনক-জননী। তারা সবাই ভারত, রাশিয়া ও অষ্ট্রেলিয়ান সরকারের শতভাগ স্কলারশিপ নিয়ে যথাক্রমে কিট বিশ্ববিদ্যালয়, ভুবনেশ্বর; সেচেনেভ বিশ্ববিদ্যালয়, মস্কো ও মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়, মেলবোর্নে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করছে।
২০২১ সালে সাহিত্যে কলকাতার বাংলা এক্সপ্রেস পদক প্রাপ্ত কবি ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য ও সৃজনশীল সবধরনের কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তার লিখা গান, কবিতা, নাটক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে। ”কথা-কাব্য” তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ। নিরব কথপোকথন ও আপন-ছায়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ “Songs of Insane” ও গল্পগ্রন্থ “মেক আপ বক্স” সহ ১০ টি গ্রন্থ প্রকাশের অপেক্ষায়। সরকারী ও বেসরকারি চাকুরীর অধ্যায় শেষ করে কবি বর্তমানে বাস করছেন নিজ বাড়ি রাজধানীর উত্তরখানের শাওনাজ ভিলায়।