মতামত

নন্দীগ্রাম নিয়ে আত্মবিশ্বাসী মমতা

মৃত্যুঞ্জয় সরদার

West Bengal Assembly Election 2021 : নন্দীগ্রাম নিয়ে আত্মবিশ্বাসী মমতা - West Bengal News 24

ভারত বর্ষ সুফলাং সুন্দর সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন দেশ। এই দেশেই গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা। ভারতবর্ষে ধর্মনিরপেক্ষ জানা সত্ত্বেও আমরা ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করে, রাজনীতিতে হিংসার পরিবেশ তৈরী করছি বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বুকে। গতকাল পশ্চিমবাংলায় রাজ্যে দ্বিতীয় দফায় ৪টি জেলায় মোট ৩০ টি আসনে ভোট গ্রহণ চলছে। একাধিক জায়গা থেকে উঠে আসছে রাজনৈতিক হিংসার খবর। সকাল থেকেই নিজ কেন্দ্র নন্দীগ্রামের (Nandigram) রেয়াপাড়ার ভাড়াবাড়িতে ঘরবন্দী ছিলেন মমতা। গণতন্ত্রের সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাবে জড়িত পরিকাঠামো ভোট ব্যবস্থা। এই ভোট ব্যবস্থায় দিনেও আগে দিনে গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে ,এটা কি কোন তন্ত্রের রক্ষা ক্ষেত্রে বাংলার জন্য মূল চাবিকাঠি। ভোট এলেই গ্রামগঞ্জে প্রতিটি মা-বোনরা আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে ওঠে, কখন যে তার ছেলের প্রাণ যায় যায় এমনই অবস্থা। গণতন্ত্রে আমরা যেভাবে গোড়ায় গলদ দেখছি ,একে অপরের উচ্চশ্রেণীর নেতৃত্বরা হিংসার মনোভাবসম্পন্ন কথা বলে সেই কারণেই বাংলার মায়েদের চোখের জল ঝরে পড়তে থাকে। তারাই তো হিংসার মনোভাব মানুষের মধ্যে বেঁধে দেয় আর সেই কারণেই বাংলায় ভোট দিনে হিংসার পরিবেশ তৈরি হয। আমরা কোনদিন শেখায়নি যে বিরোধী দল থাকতেই পারে। সর্বদায় বহু মানুষ বহু মতে বিশ্বাস হতেই পারে, একটি টেবিলে বসে সেইমত নিয়ে আলোচনা করব। কিন্তু সেটা নিয়ে হিংসার বুলি তুলবো না, এবং হিংসাত্মক ঘটনা তৈরি করব না ও হিংসাত্মক হয়ে রক্ত ক্ষয় বন্যা বইয়ে দেবো না ।তেমনভাবে, এই বাংলা কেউ গড়তে পারেনি, রাজনীতি নেতারা।সেই কারনে ঝরঝর করে চোখ দিয়ে জল পড়ছে মায়ের চোখে। সামনে পুলিশ এবং সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা। তাঁর পুত্র মৃণালকান্তি জানা নন্দীগ্রাম ২ নং ব্লকের আসনের এক বুথের তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী এজেন্ট হয়েছেন। বুধবারই এজেন্ট হিসাবে সই করেছেন। বৃহস্পতিবার, বুথে গিয়ে বিজেপির হুমকিতে ফিরে আসতে হয়েছে তাঁকে। তারপর, তাঁর মা আর তাঁকে বুথে যেতে দিতে রাজি নন।এই দেখে আমার মনে পড়ছিল,যুদ্ধক্ষেত্রের তকমা আগেই পেয়েছিল এই বিধানসভা কেন্দ্র। আসন ২৯৪। কিন্তু গোটা দেশের নজরে শুধুই নন্দীগ্রাম। কারণ, বলাই বাহুল্য দুই যুযুধান প্রার্থী। মমতা ব্যানার্জি বনাম শুভেন্দু অধিকারী। অথচ ভোটের আগে র রাত থেকেই একের পর এক হামলা, পাল্টা হামলার অভিযোগ এসেছে দুই শিবির থেকেই।

সকাল সাতটায় ভোট শুরু হয়েছে। আর তার ঠিক পর থেকেই পর পর ছবি পাল্টেছে এই কেন্দ্রের। নন্দনায়কবাড়ে সকাল ঠিক সাড়ে সাতটায় ভোট দেন এই কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী। অন্যদিকে তৃণমূল নেত্রী কলকাতার ভবানীপুর কেন্দ্রের ভোটার। নিজের ভোট দিয়েই এলাকায় ঘুরতে শুরু করেন শুভেন্দু। এদিকে ভোট শুরুর আগেই সোনাচূড়ায় বোমাবাজির অভিযোগ ঘিরে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে। সূত্রের খবর, এর পরেই স্থানীয় থানায় যান “টিম মমতা”র অন্যতম সৈনিক শেখ সুফিয়ান। কিন্তু কেন তিনি থানায় গেছিলেন সে সম্পর্কে সংবাদ মাধ্যমের সামনে মুখ খোলেননি। পরে দফায় দফায় কেন্দ্রীয় বাহিনীর সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়াতে দেখা যায় তাঁকে। সকাল ১০টা নাগাদ টুইট করে ভোটারদের ধন্যবাদ জানান মমতা। তৃণমূল নেত্রী যখন রেয়াপাড়ার ভাড়া বাড়িতে বসে ভোটের হিসেব নিচ্ছিলেন, শুভেন্দু তখন রাস্তায়। কখনও গাড়ি, কখনও বাইক নিয়ে ঘুরেছেন নন্দীগ্রাম বিধানসভার ১৭টি ব্লকে। সকাল ১১ টা নাগাদ উপস্থিত রিপোর্টারদের সামনে  তিনি দাবি করেন, ‘‌১০০ বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি তৃণমূল’‌। এদিকে সকাল থেকেই গোকুলনগর, কুলবাড়ি, সাতেঙ্গাবাড়ি সহ বিভিন্ন বুথে উল্লেখযোগ্য ভাবে চোখে পড়ে মহিলাদের লম্বা লাইন। বয়াল ১নম্বর ব্লক থেকে যখন একের পর এক অভিযোগ এসেছে তৃণমূলের পক্ষ থেকে তখন সামাদপুরে দাঁড়িয়ে শুভেন্দু বলেন, ‘‌৮৫ শতাংশ ভোট পড়বে। বিপ্লব হয়ে গেছে’‌। তবে এই সময়েই তৃণমূল সমর্থকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন শুভেন্দু। তবেই  বেলা ১টা নাগাদ বয়াল এর ৭ নম্বর বুথে পৌঁছন মমতা। কিন্তু তারপরেই কার্যত আধাসেনা দিয়ে ঘিরে রাখা হয় তাঁকে। বুথে আটকে থাকার সময় নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী মমতা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করানোর জন্য রাজ্যপালকেও (Jagadeep Dhankar) ফোন করেন। মমতা এদিন অভিযোগ করেন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই হিন্দিভাষী গুণ্ডাদের দিয়ে নির্বাচনে অশান্ত লাগানোর চেষ্টা চলছে। এমনকি তিনি এও অভিযোগ করেন ‘৮০ শতাংশ ভোট ছাপ্পা পড়েছে’ বলে। তবে বয়ালের ওই বুথ থেকে বেরিয়ে আত্মবিশ্বাসী মমতা দাবি করেন, আমিই জিতব নন্দীগ্রামে। ৯০ শতাংশ ভোট তৃণমূলই পাবে। আমি ভিকট্রি সাইন দেখাচ্ছি।’ তখন তিনি এও বলেন ‘নন্দীগ্রাম নিয়ে তিনি চিন্তিত নন, চিন্তিত গণতন্ত্র নিয়ে’।বিকেল পর্যন্ত মোট ৬৩টি অভিযোগ নথিভুক্ত করেছে তৃণমূল। মমতা জানান, ‘‌কোর্টে যাব। আইনি লড়াই হবে’‌। পরে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। অভিযোগ জানান সুনীল আরোরাকেও।  অন্যদিকে বলতেই হয় গণতন্ত্রের ভয়ঙ্কর এক চিত্র ধরা পড়ল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন ২০২১-এর দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের দিন। গত দুদিন ধরেই রাত্রিবেলায় তাঁদের বাড়িতে বিজেপি-র কর্মীরা চড়াও হয়ে তাদের হুমকি দিয়েছেন,এমনটাই অভিযোগ করেছেন ওই মৃণালকান্তি জানার মা। রাজ্য পুলিশ, কেন্দ্রীয় পুলিশ এসে নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তিনি ছেলেকে এজেন্ট হিসাবে বুথে যেতে দিতে রাজি হননি। ভোটের দিন পুলিশ নিরাপত্তা দিলেও, নির্বাচনের পর কী হবে, তা ভেবেই আতঙ্কিত তাঁরা।মৃণালকান্তি জানার মায়ের অভিযোগ, রাতে চড়াও হয়ে বিজেপির কর্মীরা তাঁদের রান্নাঘর ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর ছেলে তৃণমূলের এজেন্ট হলে তাঁদের পুরো বাড়িটিই ভেঙে দেওয়া হবে, বলে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের বাড়িতে ঢুকে তাঁর ছেলের গায়ে হাত তোলা হয়েছে, জামা কাপড় ছিঁড়ে দেওযা     হয়েছে। মৃণাল কান্তি জানার স্ত্রীও পুলিশ কর্তা ও স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের সামনে হাতজোড় করে জানিয়েছেন, তাঁদের একটি ছোট সন্তান আছে। তাঁর স্বামীই পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য। এই অবস্থায় তাঁরা কোনও মতেই মৃণালকান্তি জানাকে তৃণমূলের এজেন্ট হতে দিতে চান না।এই অবস্থায় রাজ্য পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর কর্তাদের সঙ্গে কথা কাটাকাটিতে জড়িয়ে পড়েন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। তৃণমূলের দাবি, পুলিশ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে পারছে না। অন্যদিকে, পুলিশ জানায়, এজেন্টকে বুথে তো তারা জোর করে নিয়ে আসতে পারেন না। এই ঘটনা জানতে পেরে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তৃণমূল কংগ্রেসের এজেন্টকে বসানোর ব্যবস্থাও করা হবে, বলে জানানো হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। তবে, ইতিমধ্যেই ভোটগ্রহণের অনেকটা সময় পার হয়ে গিয়েছে।এমনটা ভাবেননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এভাবে ধাক্কা দেবে তাঁকে নন্দীগ্রাম। বড় বিশ্বাস ছিল তাঁর নন্দীগ্রাম নিয়ে। এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুরের আশীর্বাদ নিয়ে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি।

সেই নন্দীগ্রামের আশীর্বাদ এখন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে অভিশাপরূপে। অথচ এই নন্দীগ্রাম আর সিঙ্গুর মমতাকে ক্ষমতায় আসার পথ দেখিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসিয়েছে। সেদিনের সেই নন্দীগ্রামের জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলন এবার অন্য এক পথের ঠিকানা দিয়েছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ এই আন্দোলনের জেরে সেদিন ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল ৩৪ বছর ধরে একটানা শাসনক্ষমতায় থাকা বামফ্রন্টকে। আর রাজ্যসিংহাসনে বসিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ‘অগ্নিকন্যা’ মমতাকে।সেদিন সেই জমি অধিগ্রহণবিরোধী আন্দোলনের জেরে রক্তাক্ত হয়েছিল সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম। সিঙ্গুরে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল ওই আন্দোলনের অন্যতম কর্মী তাপসী মালিককে। আর নন্দীগ্রামে সেই ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ আন্দোলনের দিনে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল ১৪ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে। এই আন্দোলনকে অস্ত্র করে সেদিন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মমতা। আন্দোলনে উত্তাল করে তুলেছিলেন গোটা পশ্চিমবঙ্গকে। বন্্ধ্, হরতাল আর মিছিল-মিটিংয়ে জেরবার হয়েছিল গোটা রাজ্য।দেশজুড়ে ধিক্কার উঠেছিল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা এই ঘটনার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল। মমতাও সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের প্রতিবাদে একটানা ২৬ দিন অনশনও করেছিলেন। সেদিন রাজ্যসরকার নন্দীগ্রামের গুলিবর্ষণের ঘটনা সিআইডি দিয়ে তদন্তের উদ্যোগ নিলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে রাজ্যজুড়ে। দাবি ওঠে, এই তদন্ত করাতে হবে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই দিয়ে। এই দাবিতে কলকাতা হাইকোর্টে মামলাও হয়। হাইকোর্ট অবশেষে নন্দীগ্রামের ঘটনা সিবিআইকে দিয়ে তদন্ত করানোর নির্দেশ দেন।মূলত, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি রসায়ন শিল্পাঞ্চল গড়ার জন্য তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করলে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে বিরোধী তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একইভাবে আন্দোলন চলে হুগলি জেলার সিঙ্গুরে সেই ২০০৭ সালে। সেখানে ভারতের টাটা কোম্পানিকে সস্তায় একটি মোটরগাড়ি কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে তা তুলে দেওয়া হয় টাটার হাতে। মমতা দাবি তোলেন, ৪০০ একর জমির মালিক টাটাকে জমি দিতে রাজি নয়। মমতাও ঘোষণা দেন, ক্ষমতায় এলে তিনি অনিচ্ছুক কৃষকদের সেই ৪০০ একর জমি ফিরিয়ে দেবেন। অবশেষে তা দিয়েও ছিলেন।

আর এই নন্দীগ্রাম নিয়ে নতুন করে তর্জা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে। যার নেপথ্যে মমতার পরিবর্তিত বয়ান। সোমবার নন্দীগ্রামের ঠাকুরচকে সভা ছিল মুখ্যমন্ত্রী তথা নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেখানে সভা চলাকালীনই তুলে ধরলেন নন্দীগ্রামের সাত বছর আগেকার দুর্বিষহ দিনগুলির কথা। এদিন শুভেন্দু ও তাঁরপরিবারের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ এনে বলেন, সিপিএম এর মদতে কোন পুলিশ ঢোকেনি সেদিন নন্দীগ্রামে। পায়ে হাওয়াই চটি ও সাধারণ জামাকাপড় পড়ে পুলিশ ঢুকিয়েছিল শুভেন্দু ও তাঁর পরিবার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মন্তব্যের পরে শোরগোল পড়ে গেছে রাজ্য রাজনীতিতে। উঠে আসছে হাজারো প্রশ্ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য। ‘বাপ-বেটার পারমিশন ছাড়া সে দিন পুলিশ নন্দীগ্রামে ঢুকতে পারত না।’ সঙ্গে সঙ্গে বামেদের উচ্ছাস, উল্লাস। ভক্তের মতো সবাই সোশ্যাল মাধ্যমে লিখতে শুরু করেছেন ‘ক্ষমা করবেন বুদ্ধবাবু’। অনেকেই আবার বলছেন সবই তখন তৃণমূলের সাজানো ঘটনা ছিল। ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে। উলটো স্রোতে হাঁটেন দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। তিনি সিপিআইএমএলের সাধারণ সম্পাদক। দুই পক্ষকেই দুষেছেন তিনি। তাঁর বক্তব্য যেন আরও একবার প্রশ্ন তুল দিয়েছে নন্দীগ্রামের গণআন্দোলন ও ঘটনার সত্যতাকে ষড়যন্ত্রের তকমা দেওয়ার নব্য ভাবনার দিকে।তিনি বলেছেন, ‘চোদ্দ বছর আগে ঘটে যাওয়া নন্দীগ্রাম গণহত্যায় অধিকারী পরিবারের ভূমিকা সম্পর্কে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। শুরু হয়েছে অনেক জল্পনা কল্পনা। কিন্তু অধিকারী পরিবার সম্পর্কে মমতার অভিযোগে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের শক্তিশালী গণআন্দোলন নাকচ হয়ে যায় না। একথা ঠিক যে সেই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ফসল মমতা ও তাঁর দলের ঘরে উঠেছিল। কিন্তু সে কারণে এই আন্দোলনকে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে অভিহিত করা যায় না। ঠিক যেমন আজকের কৃষক আন্দোলনকে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে দেগে দেওয়া যাবে না।’ এরপরেই তিনি বলেছেন ‘নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনাটা ছিল ঘোষিত সত্য। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক মানুষের বিক্ষোভ, আন্দোলন, জাগরণটা ছিল খাঁটি। নন্দীগ্রাম গণহত্যা ছিল একটা নির্মম বাস্তব। আর মনে রাখতে হবে, নন্দীগ্রামের ঠিক আগে সিঙ্গুর ঘটে গিয়েছিল। সেখানে পুলিশি নিপীড়ন সহযোগে জোর করে জমি নেওয়া হয়েছিল। আর এই সিঙ্গুরের সূত্র ধরেই নন্দীগ্রাম হয়ে উঠেছিল নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রামে (প্রয়াত) কমরেড শঙ্কর মিত্র, বিপ্রদাস চ্যাটার্জি এবং বর্তমানে আমাদের রাজ্য কমিটির সদস্য আইনজীবী দিবাকর ভট্টাচার্য ও ছাত্রনেতা মলয় তেওয়ারিরা যখন তথ্য অনুসন্ধানে গিয়েছিলেন তখন তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। সিঙ্গুরে আমাদের রাজ্য নেতা তপন বটব্যাল স্থানীয় কৃষকদের সাথে পুলিশের হাতে নির্যাতিত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সাধারণ মানুষের সাথে কী হয়েছিল এবং সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া কী ছিল আমরা জানি। সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে মানুষ এমনি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে নি।সেই লক্ষ্য বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। হলদি নদী পারের ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের সেই নিশ্চয়তাকে ভিত্তি করে বৃহস্পতিবার ভোটপর্ব শেষ হওয়ার আড়াই ঘণ্টা আগেই প্রত্যয়ী মমতার ঘোষণা—‘নন্দীগ্রামে জিতছি আমিই, জিতবই আমি। মানুষ ভোট আমাকে দিয়েছেন। ৯০ শতাংশ এলাকায় আমরা এগিয়ে রয়েছি।’ এতো গেল নন্দীগ্রামের প্রার্থীর কথা! বাকি যে ২৯টি আসনে এদিন ভোটে অংশ নিয়েছিল তাঁর দল, সেখানে কী অবস্থা? দৃপ্ত কণ্ঠে তৃণমূল সুপ্রিমোর ঘোষণা—‘হলদিয়া, মহিষাদল, বাঁকুড়ার মতো বাকি আসনগুলিতেও ফল ভালো হচ্ছে আমাদের। জওয়ানদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ করছেন গ্রামবাসীরা। এই জওয়ানরা আমাদের গর্ব, তাঁদের সম্মান করি।’ এরপরই গলা চড়িয়ে মমতার অভিযোগ—‘জওয়ানরাই বা কী করবেন! কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের অধীনে সিআরপি, বিএসএফ, আইটিবিপি। অমিত শাহের উস্কানিতেই তাঁরা বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমেছিলেন।’
‘দলবদলু’কে ‘ভূমিপুত্র’ তকমা দিতে বুধবার রাত থেকেই ‘অপারেশন’ শুরু হয়েছিল। রেয়াপাড়া শিবমন্দির এলাকায় যে ভাড়াবাড়িতে মমতা ‘ওয়ার রুম’ বানিয়ে বসেছিলেন, সেখানে সারা রাত ফোন এসেছে গোকুলনগর, খোদামবাড়ি, বয়াল, ভেকুটিয়া, সোনাচূড়া, কেন্দামারি, বিরুলিয়া সহ নন্দীগ্রামের নানা প্রান্ত থেকে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ এসেছিল বয়াল এলাকা থেকে। এদিন সকালেও ভোট শুরু হওয়া মাত্র অভিযোগ… সেই বয়াল থেকেই। বয়ালের ৬ ও ৭ নম্বর বুথ থেকে তৃণমূলের এজেন্টদের বের করে দেওয়া হয়েছে, মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হচ্ছে না। তৃণমূলের তরফে প্রার্থীর ইলেকশন এজেন্ট শেখ সুপিয়ান তো বটেই, কলকাতা থেকে শীর্ষ নেতৃত্ব বারবার অভিযোগ জানাতে থাকেন নির্বাচন কমিশনে। বেলা ১টার মধ্যেই মোট ৬৩টি অভিযোগ জমা পড়ে নন্দীগ্রাম নিয়ে, সর্বাগ্রে বয়াল।

বেলা একটার সময় ওয়ার রুম থেকে জানানো হয়—ম্যাডাম যাবেন বয়াল এলাকায়। সতর্ক পুলিস, নির্বাচন কমিশন, আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। টেঙ্গুয়া মোড় থেকে তেরোপেখিয়ার দিকে যাওয়ার পিচঢালা রাস্তা ধরে ছুটল মমতার কনভয়। স্থানীয় ভুঁইঞা পাড়া থেকে গ্রামের ঢালাই রাস্তা ধরে প্রায় এক কিমি দূরে বয়াল মক্তব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাত নম্বর বুথটি। হুইল চেয়ারেই রওনা দিলেন নেত্রী। বয়ালের ওই স্কুলের সামনে দু’পক্ষের জমায়েত। নাগাড়ে জয় বাংলা, খেলা হবে, আর জয় শ্রীরাম স্লোগান। কোথায় কেন্দ্রীয় বাহিনী! স্কুলের ভিতর অটোম্যাটিক রাইফেল কাঁধে সিআরপির পাঁচ জওয়ান… নির্লিপ্ত! সেই কারণে বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে নন্দীগ্রামে কে জিতবে এই প্রশ্নের উত্তরে ৪৬ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন নন্দীগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেস জিতবে। অন্যদিকে ৩৬.১ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন এই কেন্দ্রে বিজেপির শুভেন্দু অধিকারীর জয় নিশ্চিত। অন্যদিকে আবার ১০ শতাংশ মানুষ মনে করছেন সংযুক্ত মোর্চার প্রার্থী এই কেন্দ্র থেকে জয়লাভ করবে। জয়ের বিষয়ে জানাতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন ৭.৯ শতাংশ মানুষ।অন্যদিকে এই সমীক্ষার ফলাফল সামনে আসার পর শনিবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি অডিও ফাঁস (অডিওর সত্যতা যাচাই করেনি BanglaXp) করেন নন্দীগ্রামের এক বিজেপি নেতা। রাজনৈতিক মহলের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই অডিও ফাঁস হওয়ার পর কিছুটা হলেও অস্বস্তি বেড়েছে শাসক শিবিরে। যে কারণে প্রতিনিয়ত খেলা এদিক ওদিক হতে থাকায় খুব কঠিন হয়ে পড়েছে এই কেন্দ্রটি। তাই বড় পরীক্ষা নন্দীগ্রামেবিশ্লেষকরা বলছেন, ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে নন্দীগ্রামের রাজনীতিতে যে মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে, তা এই এলাকায় আগে কখনোই এত গুরুতর আকার ধারণ করেনি।

নন্দীগ্রামে দুটি ব্লক মিলিয়ে মুসলিম ভোটারের সংখ্যা ২৬ শতাংশ। সেখানে হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদী দল বিজেপির প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী প্রচারণা চালিয়েছেন ধর্মীয় বিভাজনরেখা স্পষ্ট রেখে। তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধিতাও ছিল তার প্রচারণা শিবিরের অন্যতম হাতিয়ার। বিশেষ করে, মমতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে মুসলিম তোষণের অভিযোগ ছিল নন্দীগ্রামে বিজেপির প্রচারণার বড় কৌশল।অন্যদিকে, তৃণমূল কংগ্রেস তাদের প্রচারণায় এলাকার উন্নয়নের বিষয়টিতে জোর দেয়া এবং শুভেন্দু অধিকারীর দল ছেড়ে বিজেপিতে যোগদানকে তার ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র একটা প্রতিমূর্তি হিসেবে তুলে ধরেছে।কী বলছেন ভোটাররা?নন্দীগ্রামের এক নারী ভোটার বিবিসি বাংলাকে বলেন, তৃণমূল সরকার এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছে। একারণে এবারের নির্বাচনে মমতাই জিতবেন বলে বিশ্বাস তার। এদিকে নন্দীগ্রামে ভোটের দিন ব্যাপক সহিংসতার আশঙ্কা থাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছিল স্থানীয় প্রশান। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কারণে সেখানে দুই হাজারেরও বেশি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। আতঙ্কে ছিলেন এলাকার বাসিন্দারাও। অন্য দিকে বাংলার রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বলে বক্তব্য়ের শুরুতেই জানিয়েছেন বুদ্ধবাবু। বলেছেন, ‘নমস্কার, বাংলার প্রিয় নাগরিকবৃন্দ। বিধানসবা নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। আমরা সকলেই বুধতে পারছি এরাজ্যের রাজনীতি এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বিগত বামফ্রন্টের আমলে আমরা স্লোগান তুলেছিলাম, কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। সেই চিন্তাধারা নিয়েই আমরা এগিয়েছি। কৃষিতে যেমন সাফল্য এসেছিল, তেমনই শিল্পের প্রসার ঘটতে শুরু করেছিল। বামফ্রন্ট অপসারিত হওয়ার পর তৃণমূলের সরকার রাজ্য জুড়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সমস্ত বিচারেই রাজ্যের অর্থনীতিতে নেমে এসেছে বিপর্যয়, হতাশা। কৃষিতে সঙ্কট, কৃষকের সঙ্কট। কৃষিজাত দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে। এদিকে নাগরিক জীবনের চাওয়াপাওয়াও থমকে গিয়েছে বলে দাবি এই বাম নেতার। একই সঙ্গে মহিলা নিরাপত্তা, যুব সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত নিয়েই সংশয় প্রকাশ করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বলেছেন, ‘শিক্ষায় নৈরাজ্য, স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে, নাগরিক জীবনের চাহিদাগুলি অবহেলিত। সামাজিক জীবনে গণতন্ত্র আক্রান্ত হচ্ছে। স্বৈরাচারী শাসকদল, তাদের কর্মীবাহিনী এবং সমাজবিরোধীরা একজোট হয়েছে। মহিলাদের নিরাপত্তা ভয়ঙ্কর ভাবে বিঘ্নিত। এই পরিস্থিতি চলতে পারে না। বিশেষত যুব সম্প্রদায় যাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ, তাঁরা এখন আশাহীন, উদ্যোগহীন, হতাশায় জড়িয়ে পড়ছেন। রাজ্য ছাড়ছেন অনেক যুবক। দেশের অন্যান্য জায়গায় গিয়ে চাকরির সন্ধানে বাঁচার চেষ্টা করছেন।’

আরও পড়ুন ::

Back to top button