জানা-অজানা

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

নেপালে বিমান দুর্ঘটনার বিষয়টি নতুন নয়। দুর্গম এলাকা, খারাপ আবহাওয়া, নতুন বিমানের জন্য বিনিয়োগের অভাব এবং কার্যকরী বিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকমতো নজর না দেওয়ার কারণেই মূলত দেশটিতে বিমান দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। অ্যাভিয়েশন সেফটি ডেটাবেইসের বরাত দিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৩০ বছরে নেপালে ২৭টি মারাত্মক বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২০টিরও বেশি ঘটেছে গত দশকেই।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সবশেষ গতকাল রোববার ইয়েতি এয়ারলাইনসের ‘৯ এন–এএনসি এটিআর–৭২’ মডেলের বিমান বিধ্বস্ত হয়। পুরনো বিমানবন্দর ও পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাঝামাঝি রানওয়েতে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

রোববার বেলা ১১টার দিকে কাঠমান্ডু থেকে পোখরার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল ইয়েতি এয়ারলাইনসের বিমানটি। তবে বিমান ছাড়ার পর ২০ মিনিট পার হতে না হতেই ৭২ আসনের যাত্রীবাহী বিমানটি হঠাৎ ভেঙে পড়ে। এতে বিমানটিতে আগুন ধরে যায়। এ সময় বিমানটিতে চার জন ক্রু সদস্য এবং ৬৮ জন যাত্রী ছিলেন। তার মধ্যে পাঁচ জন ভারতীয়, ৫৩ জন নেপালি এবং চার জন রুশ নাগরিক, কোরিয়ার দুজন, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স এবং আয়ারল্যান্ডের একজন করে নাগরিক ছিলেন বলে এএনআই সূত্রের খবর।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

১৯৬৯ সালের জুলাই মাস। রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্স সংস্থার একটি বিমান নেপালের সিনারা বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। বিমানবন্দরে অবতরণ করার পথেই দুর্ঘটনার শিকার হয় বিমানটি। ৩১ জন যাত্রী এবং চার জন ক্রু সদস্য এই ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

১৯৯২ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও উড়েছিল থাই এয়ারওয়েজ় সংস্থার এয়ারবাস ৩১০। ১৪ জন ক্রু সদস্য এবং ৯৯ জন যাত্রী নিয়ে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে যাচ্ছিল বিমানটি। কাঠমান্ডু থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে একটি পাহাড়ে ধাক্কা লাগে এয়ারবাস ৩১০-এর। যাত্রী-সহ ক্রু সদস্যদের সকলে এই ঘটনায় প্রাণ হারিয়ে‌ছিলেন।

পরে তদন্ত করে জানা যায়, বিমানের ডানায় কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বিমানের পাইলট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগ করলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে যোগাযোগ বারবার বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত দুর্ঘটনার কবলে পরে মৃত্যু হয় ১১৩ জনের।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

একই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। পাকিস্তানের করাচির জিন্না আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশে রওনা হয়েছিল পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স সংস্থার একটি বিমান। কাঠমান্ডু বিমানবন্দর থেকে তখনো ১১ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স সংস্থার বিমানটি।

সে সময় পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে ভেঙে যায় বিমানটি। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, এই দুর্ঘটনায় মোট ১৬৭ জন মারা গিয়েছিলেন।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

১৯৯৩ সালের জুলাই মাস। এভারেস্ট এয়ার সংস্থার একটি ডর্নিয়ার বিমান উড়ান দিয়েছিল নেপালের উদ্দেশে। কিন্তু বিমানবন্দরে অবতরণ করার সুযোগ পায়নি সেই বিমান। বিমানবন্দরে পৌঁছনোর আগেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বিমানটি।

নেপালের কাছে চুলে ঘোপ্তে পাহাড়ে ধাক্কা লাগে ডর্নিয়ার বিমানটির। বিমানে উপস্থিত ছিলেন তিন জন ক্রু সদস্যসহ ১৬ জন যাত্রী। এই দুর্ঘটনায় ১৯ জন মারা যান বলে স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

১৯৯৩ সালের পর ৭ বছর নেপালে কোনো বড়সড় বিমান দুর্ঘটনা ঘটেনি। ২০০০ সালের জুলাই মাসের একটি ঘটনা আবার পুরনো ক্ষত জাগিয়ে তোলে। রয়্যাল নেপাল এয়ারলাইন্স সংস্থা দ্বারা পরিচালিত একটি টুইন ওটার বিমান নেপালের উদ্দেশে উড়ান দিয়েছিল। কিন্তু ধানঘাধি বিমানবন্দরে পৌঁছনোর আগে দুর্ঘটনার শিকার হয় বিমানটি।

স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, তিন জন ক্রু সদস্য এবং ২২ জন যাত্রী এই দুর্ঘটনায় মারা যান।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০০১ সালের ১২ নভেম্বর। নেপালের রাজপরিবারের ইতিহাসে এক মর্মান্তিক অধ্যায় লেখা হয়েছিল সেদিন। নেপালের রাজকন্যা প্রেক্ষা শাহের (ছবিতে) মৃত্যু শোকের ছায়ায় ঘিরে ফেলে নেপালবাসীকে।

হেলিকপ্টারে চেপে নেপালের উদ্দেশে যাত্রা করছিলেন প্রেক্ষা শাহ। নেপালের পশ্চিমাংশে রারা হ্রদের কাছে পৌঁছাতেই হেলিকপ্টারটি ভেঙে যায়। হেলিকপ্টারের ভেতর ছয় জন ব্যক্তি এই দুর্ঘটনায় মারা যান। পরে হ্রদ থেকে রাজকন্যার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল বলে স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের দাবি।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

ইয়েতি এয়ারক্রাফটের একটি বিমান ২০০৬ সালের জুন মাসে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে। এই দুর্ঘটনায় বিমানের ছয় জন যাত্রী এবং ক্রু সদস্যরা মারা যান।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার’ সংস্থার তরফে অভিযানে বেরিয়েছিল শ্রী এয়ার হেলিকপ্টার। সেই উপলক্ষে নেপালের তাপলজং জেলায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখান থেকে পূর্ব নেপালের ঘুনসা এলাকার উদ্দেশে উড়েছিল হেলিকপ্টারটি।

কিন্তু গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর আগেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে শ্রী এয়ার হেলিকপ্টারটি। যাত্রী এবং ক্রু সদস্যসহ মোট ২৪ জন এই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। তদন্তে জানা যায় যে, খারাপ আবহাওয়ার কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনা। মাউন্ট এভারেস্ট থেকে ঘুরে বাড়ির পথে রওনা দিয়েছিলেন পর্যটকেরা। বুদ্ধা এয়ার সংস্থার বিচক্রাফ্ট ১৯০০ডি বিমানে চেপে নেপালে ফিরছিলেন তারা। কিন্তু মাঝ আকাশেই ঘটে দুর্ঘটনা। অতিবৃষ্টির কারণে আকাশে প্রচুর মেঘ জমে থাকায় তা বিমান চলাচলের পক্ষে খুব একটা অনুকূল পরিস্থিতি ছিল না। তাই খারাপ আবহাওয়া থাকার কারণে একটি পাহাড়ে ধাক্কা মারে বিমানটি। দুর্ঘটনার ফলে ১৯ জন মারা যান। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, ১৯ জন যাত্রীর মধ্যে ১০ জন ভারতীয় ছিলেন।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১২ সালের মে মাসের ঘটনা। পোখরা বিমানবন্দর থেকে উড়ান শুরু করে জমসম বিমানবন্দরের দিকে যাত্রা করছিল একটি ডর্নিয়ার বিমান। ২১ জন যাত্রীকে নিয়ে উড়েছিল বিমানটি। নেপালের উত্তরাংশে বেশি উচ্চতায় থাকা একটি বিমানবন্দরে নামার চেষ্টা করছিল ওই বিমান।

কিন্তু অবতরণের সময় দুর্ঘটনার মুখে পড়ে সেটি। পাহাড়ের একটি চূড়ায় ধাক্কা লাগে ডর্নিয়ার বিমানটির। এই দুর্ঘটনায় ১৫ জন মারা যান। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, ১৫ জনের মধ্যে ১৩ জন ভারতীয় এবং তারা সবাই তীর্থযাত্রী ছিলেন।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১৫ সালের মে মাস। নেপাল সেই সময় ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছিল। চারিকোট এলাকায় তখন ‘সহযোগী হাট’ নামের অপারেশন চালানো হয়। ইউএইচ-১ওয়াই হুয়ে হেলিকপ্টার চারিকোট এলাকায় ত্রাণ পৌঁছতে গিয়েছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার কবলে পড়ে প্রাণ হারান হেলিকপ্টারে থাকা আট জন ব্যক্তি। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, আট জনের মধ্যে দুজন নেপালি সৈন্য ছিলেন।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ১১ জন যাত্রী নিয়ে নেপালের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল এয়ার কাষ্ঠামণ্ডপ এয়ারক্রাফ্টের একটি বিমান। নেপালের কালিকোট জেলার কাছে পৌঁছতে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। ঘটনায় দু’জন ক্রু সদস্য মারা যান এবং ৯ জন যাত্রীকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১৮ সালের ১২ মার্চ। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি বিমান ঢাকা থেকে ৬৭ জন যাত্রী এবং চার জন ক্রু সদস্য নিয়ে ফিরছিল। কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করার কথা ছিল বিমানটির। কিন্তু পাইলট হঠাৎ বিমানের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলায় বিমানবন্দরের কাছে একটি ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ে বিমানটি।

ফুটবল মাঠে আছড়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ জোরে একটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। আগুন লেগে যায় বিমানটিতে। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, এই ঘটনায় ৪৯ জন মারা যান।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। খারাপ আবহাওয়ার কারণে উড়ানে সমস্যা দেখা দেবে বলে আবার নেপালে ফিরছিল একটি এয়ার ডাইন্যাস্টির হেলিকপ্টার। কিন্তু নেপালে ফেরার পথে একটি পাহাড়ে ধাক্কা মারে হেলিকপ্টারটি। এই দুর্ঘটনায় সাত জন মারা যান। স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, ওই হেলিকপ্টারে নেপালের তৎকালীন পর্যটনমন্ত্রী রবীন্দ্র অধিকারীও ছিলেন। দুর্ঘটনার ফলে তিনি প্রাণ হারান।

দুর্ঘটনার পর অবিলম্বে একটি তদন্ত কমিটি তৈরি করা হয়। তাদের তরফে জানানো হয় যে, হেলিকপ্টারে যে ফুয়েল ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হয়েছিল তার অবস্থান ঠিক ছিল না। ফলে হেলিকপ্টারের ওজনের ভারসাম্য রক্ষা হয়নি। এমনকি আসন ব্যবস্থাও সঠিক ছিল না। তাই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে হেলিকপ্টারটি।

নেপালে তিন দশকে ২৭ বিমান দুর্ঘটনা, নেপথ্যে যত কারণ

২০২২ সালের মে মাসে খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফের বিমান দুর্ঘটনার সাক্ষী হয় নেপাল। তারা এয়ারপ্লেন সংস্থার একটি বিমান ২২ জন যাত্রী নিয়ে নেপালের উদ্দেশে উড়েছিল। কিন্তু নেপালের মুসতাং জেলায় পৌঁছতেই ঘটল দুর্ঘটনা। এই এলাকা পাহাড়ে ঢাকা। খারাপ আবহাওয়া থাকার কারণে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা লেগে বিমানটি দুর্ঘটনার মুখে পড়ে। দুর্ঘটনার ফলে ২২ জন মারা যান।

স্থানীয় সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, ২২ জনের মধ্যে চার জন ভারতীয় ছিলেন। ঠাণের বাসিন্দা ছিলেন তারা। দুর্ঘটনার তিন দিন পর দুর্ঘটনাস্থল থেকে সবার দেহ উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন ::

Back to top button